বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

পাঁচশো বছর ধরে বঙ্গে পূজিত হচ্ছেন লৌকিক দেবী ওলাইচণ্ডী

May 21, 2023 | 2 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: লোকবিশ্বাস অনুসারে, ওলাওঠা রোগ তথা কলেরা রোগ নিরাময়ের দেবী ওলাইচণ্ডী। আজও এই দেবীর প্রতি ভক্তদের বিশ্বাস এক ইঞ্চিও ভাটা পড়েনি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত, মা সকলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। এই পুজোয় নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে পুজোর পৌরহিত্যে যেকোন‌ও বর্ণ বা সম্প্রদায়ের লোক, এমন কি নারীরও অধিকার আছে। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত। ওলাইচণ্ডী বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবী।

লোক সংস্কৃতি-গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, ওলাইচণ্ডী দেবীর আদি নাম ওলাউঠা-চণ্ডী বা ওলাউঠা-বিবি। বিসূচিকা বা কলেরা রোগের অপর নাম ‘ওলাউঠা’ বা ‘ওলাওঠা’ শব্দটি দু’টি প্রচলিত গ্রাম্য শব্দের সমষ্টি – ‘ওলা’ ও ‘উঠা’ বা ‘ওঠা’। ‘ওলা’ শব্দের অর্থ নামা বা মলত্যাগ এবং ‘উঠা’ বা ‘ওঠা’ শব্দের অর্থ উঠে যাওয়া বা বমি হওয়া। হিন্দু-মুসলিম সহ শ্রেণী-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজে সকল সম্প্রদায়ের উপাস্য এই দেবী।

প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অনুসারে, ওলাইচন্ডী দেবীর পুজো তিন রকমের হয়ে থাকে। প্রতি শনিবার এবং মঙ্গলবার অনাড়ম্বরে যে পুজো হয়, তা বারের পূজা নাম পরিচিত। কারও মানত উপলক্ষে সামান্য আড়ম্বরের সঙ্গে যেকোন‌ও সময়, এই দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া কোথাও কলেরা রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে, সে এলাকার লোকজন সমষ্টিগতভাবে এই দেবীর পুজো দেন।

এই দেবীকে কেন্দ্র করে প্রচুর প্রবাদ, ইতিহাস, কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। প্রাচীন কালে ওলাদেবী অসাম্প্রদায়িক দেবী অর্থাত্‍ ধৰ্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এঁর পূজা করা হত। ওলাইচন্ডী দেবীর পূজা এককভাবেও হয়ে থাকে। আবার ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসনবিবি এই ছয়জনের সঙ্গে একত্রেও হয়। এঁদের একত্রে বলা হয় সাতবিবি। কার‌ও কার‌ও মতে এঁরা ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বারাহী, প্রভৃতি পৌরাণিক দেবীর লৌকিক রূপ। শনি ও মঙ্গলের প্রকোপ থেকে বাঁচতে হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এই দেবীর পুজো করা হয়।

অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন মহেঞ্জোদাড়ো শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে প্রাপ্ত একটি সিলমোহরে সাতজন নারীকে একসঙ্গে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আইন-ই-আকবর ও কবি কঙ্কন মুকুন্দরামে চন্ডীতে উলার নাম পাওয়া যায়। শোনা যায়, ১১৭৬ বঙ্গাব্দে তৎকালীন পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবী উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া অঞ্চলে পরেশনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে এক সুবৃহৎ মন্দিরে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি স্থাপন করেছিলেন।

কথিত আছে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির জনৈক কুঠিয়ালের স্ত্রী শ্রীমতী ডনকিং কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ওলাইচণ্ডী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ডনকিং এক মুসলমান আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে সেই পঞ্চানন মন্দিরে এসে পূজারিণী ব্রহ্মময়ী দেবীকে স্বপ্নের কথা জানালে ব্রহ্মময়ী দেবীই নিকটবর্তী একটি ঝিল থেকে ওলাইচণ্ডীর শিলামূর্তি মাথায় করে নিয়ে এসে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন।

মনসামঙ্গলের কাহিনী অনুসারে প্রায় ৫০০ বছর আগে উলা গ্রামের পাশে গঙ্গা নদী পথে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন লখিন্দরের বাবা এবং বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সদাগর। কথিত আছে, সে সময় পাথরে ধাক্কা লেগে চাঁদ সদাগরের নৌকা ডুবে যায়। এরপরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে উলা গ্রামে শিলাখণ্ড প্রতিষ্ঠা করে মা চন্ডীর আরাধনা শুরু করেন চাঁদ সদাগর।

পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওলাইচন্ডী দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতি বছরই শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটে এই পুজোয়, অনুষ্ঠিত হয় মেলাও।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Olaichandi Temple, #Olaichandi

আরো দেখুন