নজরুলের প্রবন্ধে বিপ্লবী চেতনা
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কাজী নজরুল ইসলাম জাত-প্রাবন্ধিক না হলেও দেশের প্রয়োজনের স্বার্থে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। প্রধানত দুটি পত্রিকা ‘নবযুগ’আর ‘ধূমকেতু’তে সম্পাদনার জন্য তাঁকে মাঝে মধ্যেই কিছু না কিছু লিখতে হত। সেই লেখাগুলিই পরবর্তীকালে ‘যুগবাণী’, ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’ গ্রন্থগুলিতে স্থান পায়। প্রবন্ধগুলি সমসাময়িক ঘটনার নিরিখে রচিত হলেও সংবাদপত্রের প্রয়োজনেই মূলত লেখা হয়েছিল।
এই দুটি দিকই তাঁর প্রবন্ধ রচনার উৎসও প্রেরণা। নজরুলের প্রবন্ধের সংখ্যা মোট পাঁচটি –
১) ‘যুগবাণী’ (কাৰ্ত্তিক, ১৩২৯)।
২) ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ (মাঘ, ১৩২৯)।
৩) ‘রুদ্রমঙ্গল’(১৩৩৪)।
৪) ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৩৩৩)।
৫)‘ধূমকেতু’(অগ্রহায়ণ, ১৩৫৭)।
নজরুলের প্রবন্ধগুলিতে তাঁর ভাষা পৌরুষ ও অকৃত্রিম ভাববেগে পূর্ণ। এছাড়া ব্যক্তিমানসের দৃষ্টিভঙ্গি ও পূর্ণ জীবন সমালোচনার জন্য অমূল্য সম্পদ।
নজরুলের জীবনী পর্যালোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাকে যতই দমিয়ে রাখার অপকৌশল করেছে তিনি ততই ‘বাঁধনহারা’র মতো অবিরাম ছুটেছেন। ক্ষিপ্র সে গতি। কখনও উল্কার বেগ, কখনওবা প্রলয়ঙ্করী মহাঝড় কিংবা মহাপ্লাবণ হয়ে। তিনি যে পথ মাড়িয়েছেন, তা ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়েছেন। কাঁপিয়ে দিয়েছেন ইংরেজ শাসকের ভিত।
তারুণ্যতেজদীপ্ত নজরুল কবিতার মাধ্যমে তৎকালীন ইংরেজ শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা করলেও সাহিত্যের অপরাপর শাখা যেমন, নাটক, গল্প, উপন্যাস ও সংগীতেও বিপ্লবের ধারা সচেতনভাবেই এগিয়ে নিয়েছেন। সাংবাদিকতার সময় লিখেছেন শক্তিশালী ও ক্ষুরধার প্রবন্ধ। কালক্রমে ওই প্রবন্ধগুলোই হয়ে উঠেছে বিপ্লবের সমার্থক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শাসকগোষ্ঠীর হাতে সাধারণ নাগরিক যে কতটা নিপীড়িত, নিঃগৃহিত ও শোষিত ছিলেন তা সে সময়পর্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়। সামাজিক এ ভঙ্গুর অবস্থা সত্যসন্ধানী ও ন্যায়ের পথে লড়াকু নজরুলের চেতনায় গভীর অভিঘাতের সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে এ সময়পর্বে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া আন্দোলন নজরুলের বিদ্রোহীসত্তাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে। তিনি একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হন দেশের দারিদ্র, কুসংস্কার, নারীর অধিকারহীনতা ও অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অসঙ্গতির কারণে।
রাষ্ট্রীয় শোষণ থেকে জনমুক্তির উপায় হিসেবে সাধারণ নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সাহিত্যিক প্রতিবাদকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি লিখেছিলেন প্রবন্ধ। কবিতা ও গানের তুলনায় তার প্রবন্ধ সংখ্যা কম হলেও এসব প্রবন্ধে প্রত্যক্ষ করা যায় তৎকালীন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের চিত্র এবং নজরুল মানসে তার অভিঘাতের পরম্পরা।
প্রবন্ধের ভেতর দিয়ে কাজী নজরুলকে পাওয়া যায় সার্বিক দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে। নজরুলের কবিজীবন যেমন অখণ্ডিত, তেমনি প্রাবন্ধিক জীবনও অবিচ্ছিন্ন, অনমনীয় ও আপোসহীন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাস।