নিজেদের স্বার্থে নতুন ইতিহাস রচনা করছে আরএসএস-বিজেপি, সরব ইরফান হাবিব
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাক্রম থেকে মুঘল ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের কেন্দ্রীয় সিলেবাসে আর থাকবে না মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। এপ্রিল মাসের কথা। ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং বা এনসিইআরটি জানায়, তাদের দ্বাদশ শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে গোটা মুঘল সাম্রাজ্যই! সেই নিয়ে হইচই পড়ে যায় দেশজুড়ে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ফের একটি ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে মোদী সরকার! দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল শুক্রবার জানায়, স্নাতক স্তরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়তে চলেছে উর্দু কবি মহম্মদ ইকবালের জীবনী।
প্রজাতন্ত্র দিবস হোক বা স্বাধীনতা দিবস, পাড়ায় পাড়ায় যেসব দেশাত্মবোধক গান বাজে, সেই তালিকায় অবশ্যই থাকে ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা, হিন্দুস্থাঁ হামারা…’। আর এই গান উঠে এসেছিল কবি ইকবালের কলমেই। ফলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে ইকবালের জীবনী বাদ পড়ায় নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিল, তা বলাই বাহুল্য।
মোদী সরকারের এই ‘নতুন ইতিহাস’ রচনার চেষ্টা নিয়ে একটি সর্বভারতীয় নিউজ পোর্টালে একটি নিবন্ধ লিখেছেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। তিনি লিখেছেন- আরএসএস এবং তাদের সমমনোভাবাপন্ন দলগুলি (যারা তাদের ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত) মনে করে তাদের সহ নাগরিকদের একটি অংশ ‘বিদেশী’। তাদের বিভিন্ন সময় মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের বংশধর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্ধ-শিক্ষিত এই প্রচারকদের কাছে ভারতীয় মুসলমানদের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের বিষয়টি উপক্ষিত থেকে যায়।
সেই সময়ের তুর্কো-আফগান বা পার্সি ও আরব আভিজাত্যের সাথে কোনো যোগসূত্র দাবি করতে পারে এমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কমই আছে। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ভারতীয় যারা বিভিন্ন কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্যই কিছু জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনাও ঘটিছিল।
নির্বাচনে ফয়দা তোলার জন্য শুধু ধর্মের নামে দেশকে মেরুকরণ এবং অতীত নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ভারতে ‘মুসলিম শাসনের ৭০০ বছরের’ চিরস্থায়ী ধর্মীয় সংঘাত সম্পর্কে এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচার আফিমের মতো কাজ করে। যার ফলে দৈনন্দিন জীবনের দুর্দশার কথা ভুলে একটি অংশের মানুষ কেবল ধর্মীয় বিষয়গুলিকে নিয়ে মাতামাতি করে চলেছে।
বিগত কয়েক বছরে, আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মূলত হোয়াটসঅ্যাপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ছড়ানোর মাধ্যমে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরির একটি কৌশল অবলম্বন করছে। আমাদের মধ্যযুগীয় অতীতকে নিছক হিন্দু-মুসলিম বিরোধের ক্ষেত্রে পরিণত করে দেখানোর চেষ্টা চলছে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা ‘বর্বর’ মুসলিম শাসকদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল।
দুঃখের বিষয়, এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়-সহ আমাদের বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসও নতুন করে লেখা হচ্ছে! এই “নতুন ইতিহাস” আমাদের জাতীয় নেতাদের মধ্যে মতবিরোধের উপর বেশি জোর দেয়, যেমন জওহরলাল নেহেরু বনাম সর্দার প্যাটেল, সুভাষ বোস বনাম গান্ধী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত সংগ্রাম সম্পর্কে সেরকমভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে না। অথচ, গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যান্যরা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন।
এনসিইআরটি একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বইয়ে উল্লিখিত রাষ্ট্র নেতাদের তালিকা থেকে মৌলানা আজাদকে বাদ দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে! অথচ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ যা মৌলানা আজাদকেও রেহাই দেয় নি। দুঃখজনকভাবে, তিনি বিভক্ত মানসিকতার শিকার হয়েছিলেন। এমন একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি সারাজীবন লড়াই করেছিলেন।
আমাদের মধ্যে সর্বদা অতীত নিয়ে একটা বিশ্বাস তৈরির করার প্রচেষ্টা চলে- এমন একটি সময় ছিল যখন হিন্দুরা মুঘলদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। P.N.Oak-এর মতো লোক ছিলেন। যিনি একটি ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে সৃজনশীলভাবে কল্পনা করে একটি অতীত তৈরি করেছিলেন। তিনি বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পুরো বিষয়টিকে দেখেছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্যের কোনো স্থান ছিল না এবং তার উপর ভিত্তি করে মধ্যযুগীয় মুসলিম আমলের প্রায় সব স্মৃতিস্তম্ভ সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। এখন আবার নতুন প্রজন্মের কিছু ডানপন্থী ‘বুদ্ধিমান’ চৌকসভাবে এমন একটি ইতিহাস তৈরি করতে চাইছেন যা বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদও নন। এমনকি একজন অর্থনীতিবিদও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ‘চতুরতার’ সঙ্গে ইতিহাস লিখে ফেলছেন। এখানে সত্য, তথ্য এবং দক্ষতার দ্বন্দ্ব প্রকট। ফলে এনসিইআরটি বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির হস্তক্ষেপকে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শ-চালিত দৃষ্টিভঙ্গি বলেই মনে করা উচিত।