রামপ্রসাদের হালিশহরে চলছে তিনশো বছরের প্রাচীন রুদ্রভৈরবী পুজো
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: দুর্ভীক্ষ থেকে রক্ষা পেতে রুদ্রভৈরবীর পুজো শুরু হয়েছিল বঙ্গে। আজও সেই পুজো হয়ে আসছে। রামপ্রসাদের হালিশহরে পূজিতা হন দেবী রুদ্রভৈরবী। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে হালিশহরের বকুলতলার বাজারপাড়ার রুদ্রভৈরবীতলায় শুরু হয় রুদ্র ভৈরবীর পুজো।
হালিশহরে ছড়িয়ে পড়েছিল দুর্ভীক্ষ। দুর্ভীক্ষপীড়িত মানুষজন এক তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হন, উদ্দেশ্য ছিল পরিত্রাণের উপায়। তান্ত্রিক বলেন, দেবী রুষ্ট হয়েছেন বলেই প্রকৃতি এমন ধারণ করেছে। দেবীর রুদ্র রূপ রুদ্রভৈরবীর উপাসনা করলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে প্রকৃতিকে আবার সুজলা সুফলা করে তুলবেন, এমন নিদান দেন ওই তন্ত্র সাধক। দেবীর রূপ ও পূজাপদ্ধতি বিষয়ে পরামর্শও দেন তিনি। হালিশহরের রামসীতাগলি নিবাসী রামদুলাল চক্রবর্ত্তী বাজারপাড়ায় দেবীর পুজোর জন্য জমিদান করেন। সেই জমিতেই শুরু হয় দেবী রুদ্রভৈরবীর আরাধনা। জায়গাটি রুদ্রভৈরবীতলা নামে খ্যাত।
১৮৮৩-৮৪ নাগাদ হালিশহরে ভয়াবহ ম্যালেরিয়ার প্রদুর্ভাব ঘটে। বহু মানুষ প্রাণ হারান। প্রাণের ভয়ে হালিশহর ত্যাগ করেন অনেকে। রুদ্র ভৈরবীর পুজোর ছেদ পড়ে। প্রায় ৬০ বছর পর ফের ভরে উঠল হালিশহর। এবার মানুষ রুদ্রভৈরবীতলা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠল। অনেকেই রুদ্রভৈরবীতলা নামকরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইল। প্রবীণরা কেউ কেউ কিছু কিছু বললেন কিন্তু বিস্তারিত জানা গেল না। দেবীর রূপ ও পুজো পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে, রামপ্রসাদের মন্দিরের তৎকালীন পুরোহিত পণ্ডিত শিবকুমার ভট্টাচার্যের কাছে গেলেন একদল। শিবকুমার ভট্টাচার্য ভাটপাড়ার বিখ্যাত পণ্ডিতসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ তখন রুদ্রভৈরবী দেবী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন। শিবকুমার নিজে হাতে দেবীর পুজোপদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক ক্রিয়া সম্পর্কে পুঁথি লিখেছিলেন। ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবীর মূর্তি তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি অর্থাৎ জামাই ষষ্ঠী থেকে দশহরা তিথি পর্যন্ত পাঁচদিন পুজোর তিথি হিসেবে নির্ধারিত হয়। ১৯৪৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের অরণ্যষষ্ঠীতে বাজারপাড়ার রুদ্রভৈরবীতলায় শিবকুমার ভট্টাচার্যের পৌরহিত্যে দেবী রুদ্রভৈরবী পুনঃপ্রতিষ্ঠিতা হলেন।
তন্ত্রমতে পূজিতা দেবী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হল। তাই ১৯৪৪ সালে পুজো যখন নতুন করে আরম্ভ হল, তখন রুদ্রভৈরবী পুজোর সঙ্কল্পে কেউ নিজের নাম যুক্ত করতে রাজি হলেন না। দেবীর পুজোয় ত্রুটি হলে দেবীর কোপ সঙ্কল্পকারীর উপর নেমে আসবে, এই ভয়ে বাজারপাড়ার অধিবাসীরা কেউই নিজের নামে সঙ্কল্প হতে দিলেন না। তখন দেবীর নামেই পুজো শুরু হল। কিছু বছর পর বাজারপাড়ানিবাসী নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিধবা বৃদ্ধা পত্নী নিজের নামে দেবীপুজোর সঙ্কল্প করালেন। সেই পথ অনুসরণ করে পরবর্তী কিছু বছর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধবৃদ্ধাগণের নামে সঙ্কল্প করে পুজো অনুষ্ঠিত হল। তারপর দেবী পুজোর সঙ্কল্প আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাখা হল না, গোত্র ধরে ধরে সকল পল্লীবাসীর নামেই সঙ্কল্পের ব্যবস্থা করা হল।
প্রতি বছর জামাইষষ্ঠী থেকে দশহরা পর্যন্ত পাঁচদিন ধরে দেবী রুদ্রভৈরবীর পুজো হয়। পাঁচ দিনের উৎসবে মেতে ওঠে হালিশহর।