বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

৫০০ বছর ধরে চলে আসছে পানাগড়ের ‘ক্ষেত্ররক্ষক’ দেবতার পুজো

June 14, 2023 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ক্ষেত্রপাল মূলত ভূমিরক্ষক এবং কৃষির লৌকিক দেবতা হিসেবে পূজিত হন৷ ক্ষেতের পালন কর্তা শব্দ থেকেই ক্ষেত্রপাল নামটির উৎপত্তি হয়েছে। বাংলার বিভিন্ন গ্রামীন এলাকাগুলিতে পুজোর প্রচলন আছে লৌকিক দেবতা ক্ষেত্রপালের। এর মধ্যে বর্ধমানের পানাগড়ের অধীনস্থ ক্ষেত্রপাল মন্দিরের পুজো আনুমানিক পাঁচশো বছরের পুরনো৷

স্থানীয় এলাকার মানুষ, পরিবারের যে কোনও শুভ কাজে এই মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। মূলত ভৈরব মূর্তির এই দেবতাকে ভক্তরা শিবের একটি রুদ্র রূপ হিসেবে বিশ্বাস করেন৷ ক্ষেত্রপাল কোথাও মূর্তির আকারে কোথাও বা শিলার আকারে পূজিত হন৷

ভক্তদের বিশ্বাস করেন, এই মন্দিরে ঘন্টা বাঁধলে সব মনস্কামনা পূর্ণ হয়। দেবতার আশীর্বাদ পাবার আশায় ভক্তগণ মন্দিরে মানত করে মাটির ঘোড়া বাঁধেন৷ পরে আশা পুরণ হলে যে-কোনও একটি ঘোড়া খুলে পিতলের ঘণ্টা বেঁধে আসেন৷ আর সে কারণেই বহু কাঁসা-পিতলের ঘন্টা দ্বারা বেষ্টিত রয়েছে ক্ষেত্রপাল মন্দির। সে কারণে, এই মন্দিরের আরেক নাম ঘন্টা বাবার মন্দির।

ক্ষেত্রপালের ধ্যানমন্ত্রে ঘণ্টার উল্লেখ আছে এবং ‘বিশ্বকোষ ’ ও ‘প্রয়োগসার ’ নামক তন্ত্রগ্রন্থে ক্ষেত্রপালের নাম ‘ঘণ্টাদ ’ থেকেই বোধ হয় এই ঘণ্টা বাঁধার রীতি৷ অনেকে ঘণ্টাবাবা হিসেবে অভিহিত করেন ক্ষেত্রপালকে৷ ক্ষেত্রপাল মন্দির চত্বরেই আছে কালী , তুলসী এবং গণেশ মন্দির৷ ক্ষেত্রপালের পাশাপাশি তাঁরাও মানত হিসেবে ভক্তদের কাছ থেকে ঘণ্টা পান৷ সেনাছাউনির আবাসিকরা খুবই মান্য করেন ক্ষেত্রপাল দেবতাকে৷ কোনও রেজিমেন্ট সেখান থেকে চলে গেলে একটি স্মারক তৈরি করে দিয়ে যান৷ এমনই বেশ কয়েকটি স্মারক চোখে পড়ে এই এলাকায়৷

মত্স্যপুরাণে বর্ণিত ক্ষেত্রপালের মূর্তির বিবরণ অনুযায়ী, ক্ষেত্রপালকে জটামণ্ডিত ও বিকৃতানন করে নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে৷ ক্ষেত্রপাল দিগম্বর , জটিল , কুকুর ও শৃগাল বেষ্টিত , তাঁর মস্তক কেশসমাবৃত, বাম হস্তে কপাল , দক্ষিণ হস্ত অসুরনাশিনী শক্তি প্রদান করে৷

ক্ষেত্রপালের একটি ধ্যানমন্ত্রও আছে , যার অর্থ —‘উজ্জ্বল ভয়ংকরজটাধারী , ত্রিনয়ন , নীল কজ্জ্বল ও পর্বতসদৃশ প্রভাবিশিষ্ট , দুই হাতে ধৃত গদা ও কপাল , রক্তবর্ণমাল্য , গন্ধ ও বস্ত্রে উজ্জ্বল, কটিতে বদ্ধ ঘণ্টার ঘর্ঘরশব্দের ভীষণ ঝংকারে ভয়ংকর , সাদা সর্পের কুণ্ডলধারী ভগবান ক্ষেত্রপালকে আমি বন্দনা করি৷ ’

‘বিশ্বকোষ ’-এর চতুর্থ খণ্ডে ক্ষেত্রপালের ৪৯ প্রকার রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলি হল ১. অজর , ২. আপকুন্ত, ৩ . ইন্দ্রস্ত্ততি , ৪ . ঈড়াচার , ৫ . উক্ত , ৬. উন্মাদ , ৭ . ঋষিসূদন , ৮ . ঋমুক্ত, ৯ . লিন্তকেশ , ১০. ল্লিপক , ১১. একদংষ্ট্রক , ১২. ঐরাবত , ১৩ . ওঘবন্ধু, ১৪ . ঔষধীশ , ১৫ . অঞ্জন , ১৬. অস্ত্রবার , ১৭ . কাল , ১৮ . খরুখানল , ১৯ . গামুখ্য , ২০. ঘণ্টাদ , ২১. ঙ্মনঃ , ২২. চণ্ডবারণ , ২৩ . ছটাটোপ , ২৪ . জটাল , ২৫ . ঝঙ্গীবঃ , ২৬. ঞড়শ্চর , ২৭ . টঙ্গপাণি , ২৮ . ঠাণবন্ধু, ২৯ . ডামর , ৩০ . চক্কাবর , ৩১ . লবর্ণি, ৩২ . তড়িদ্দেহ , ৩৩ . স্থির , ৩৪ . দন্ত্তর , ৩৫ . ধনদ , ৩৬ . নত্তিক্তান্ত , ৩৭ . প্রচণ্ডক , ৩৮ . ফট্কার , ৩৯ . বীরশঙ্খ , ৪০ . ভঙ্গ , ৪১ . মেঘাসুর , ৪২ . যুগান্তক , ৪৩ . রৌহ্যক , ৪৪ . লম্বৌষ্ঠ , ৪৫ . বসুগণ , ৪৬ . শূকনন্দ , ৪৭ . ষড়াল , ৪৮ . সুনামা , ৪৯ . হংব্রুক৷

মঙ্গলকাব্যগুলিতে শিব স্বয়ং কৃষিকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন৷ যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় স্তোত্রে রুদ্রকে ক্ষেত্রপতি বলা হয়েছে৷ তন্ত্রশাস্ত্রে শিবের একটি নাম ক্ষেত্রপাল বা ক্ষেত্রেশ৷ সুতরাং ক্ষেত্রপাল যে শিবেরই রূপান্তর , তাতে সংশয় নেই৷

সদূক্তিকর্ণামৃত নামক সংস্কৃত কোষগ্রন্থে এবং কোনও কোনও মঙ্গলকাব্যে ক্ষেত্রপালের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ কোনও কোনও স্থানে ধর্মরাজের পুজোয় চতুর্দিকের অধিপতি হিসেবে ক্ষেত্রপালের বন্দনা করা হয়৷ বৌদ্ধ মহাযানীদের মধ্যেও ক্ষেত্রপালের পুজো প্রচলিত ছিল৷

জানা যায়, আগে একটি পুরাতন তেঁতুলগাছের নীচে ক্ষেত্রপাল মন্দিরটি অবস্থিত ছিল৷ ক্ষেত্রপাল এখানে প্রস্তরখণ্ড রূপে অবস্থান করছেন ৷ প্রথমে ক্ষেত্রপাল ছিল খোলা আকাশের নীচে৷ বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষেত্রপালের মাথার ওপর একটি ধাতুনির্মিত ছাতার মতো ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়৷ তার বহু পরে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে ৷

জানা গেছে, পানাগড়ে ক্ষেত্রপাল মন্দির সংলগ্ন এলাকায় সেনা ঘাঁটি গড়ে তোলা হয় কিন্তু মন্দিরটি সরানোর ক্ষেত্রে স্থানীয়রা বিরোধ প্রকাশ করেছিলেন। ফলে ক্ষেত্রপাল শিব মন্দিরটি বিমান ঘাঁটির ভিতরে রয়ে গেছে। ভারতীয় সেনা নিজেদের কাঁধে মন্দিরটির পরিচর্যা এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে নেয়। যা, মন্দিরটির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ক্ষেত্রপাল মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন বেশ কয়েকজন পুরোহিত। মন্দির খোলা থাকে সকাল ছ ’টা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত৷ নিত্যপুজোয় নারকেল , ফল , মিষ্টি দেওয়ার রীতিই প্রচলিত৷ মার্চ মাসের প্রথম সন্তাহের শনি ও রবিবার হয় বাত্সরিক উত্সব৷ ভক্তদের আর্থিক অনুদানেই আয়োজিত এই উত্সবে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়৷

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Panagarh, #khetrapal, #West Bardhaman

আরো দেখুন