জেনে নিন পুরীর জগন্নাথ দেব ও Ratha Yatra-র অজানা ইতিহাস
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন, আর সেই তেরো পার্বনের একটি হল রথযাত্রা৷ বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ রথযাত্রা। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কাঠের তৈরি রথে করে মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের বিগ্রহকে পরিভ্রমন করানো হয়।পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে এই রথযাত্রার উদ্ভব৷ হাজার হাজার ভক্ত এবং পর্যটকরা জুলাই মাসে রথযাত্রা উৎসবে সামিল হন।
জেনে নিন রথযাত্রার অজানা তথ্য
বৈদিক শাস্ত্র থেকে জানা যায়, জগন্নাথ আসলে শ্রীকৃষ্ণ অবতার একটি বিশেষ রূপ। দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন, শান্তি ও আনন্দময় এবং ধর্ম সংস্থা স্থাপনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বভুবনে এসেছেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম বৃন্দাবন লীলা শেষ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে যান এবং দ্বারকায় রাজা হন। শ্রীকৃষ্ণকে বৃন্দাবন বারবার আকৃষ্ট করে তোলে।
একবার সূর্য গ্রহনের সময় দ্বারকাবাসীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ পুণ্য লাভের জন্য কুরুক্ষেত্রে যান। এইদিকে সমস্ত বৃন্দাবনবাসী সূর্য গ্রহনের পুণ্য লাভের জন্য কুরুক্ষেত্রে আসে। অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর বৃন্দাবনের বজ্রবাসীদের সাথে সাক্ষাৎ হয় স্বয়ং ভগবান জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের সাথে। ভগবান জগন্নাথ জগদীশ্বর নামেও পরিচিত।
কথিত আছে, বজ্রবাসীরা শ্রীকৃষ্ণকে রাজা হিসাবে না দেখে, বৃন্দাবনের কৃষ্ণ লীলা হিসাবে দেখতে চাইলেন। বজ্রবাসীরা সকলেই প্রার্থনা করলেন হাত জোড় করে শ্রীকৃষ্ণের কাছে। হে প্রভু আমরা প্রত্যেকেই এখানে রয়েছি, তুমিও এখানে রয়েছো। একটি বিষয়ে আমাদের খুব অভাব রয়েছে, সেটি হল মধুময় বাল্য লীলা, চলো আমরা সকলেই মধুময় বাল্য লীলা বৃন্দাবনে ফিরে যাই। এইকথা বলেই সকল বৃন্দাবনবাসী, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা দেব দেবীরা সবাই মিলে রথের ঘোড়া টেনে টেনে বৃন্দাবনে নিয়ে যান।
সেই দিনকেই স্মরণ রেখেই ভক্তরা আপন মনে ও আন্তরিকতার সাথে রথযাত্রা আয়োজন করা হয়ে থাকে। ভক্তরা রথের দড়ি টেনে নিয়ে বৃন্দাবনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ভক্তরা রথের রশি ধরে ভগবান জগন্নাথ( শ্রীকৃষ্ণকে) অনুভব করে। আর পরম্পরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল ভক্তকে পুণ্য লাভের আশীর্বাদ করেন।
পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায়, রাজার হাত ধরে রথযাত্রার ইতিহাসের কথা। তখন সত্যযুগ, মালবদেশ এর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলে শ্রী হরি তথা বিষ্ণু ভক্ত। তিনি গড়ে তুলেছিলেন জগন্নাথধাম থথা শ্রীক্ষেত্র নামের পবিত্র মন্দির। কিন্তু মন্দিরে ছিলো না কোনো বিগ্রহ।একদিন এক সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। রাজার সেবা যত্নে তুষ্ট হয়ে তাকে বললেন নীলমাধব ( ভগবান বিষ্ণুর আরেক রুপ) এর গুপ্তভাবে শবরদের মাধ্যমে পূজিত হবার কথা। নীল পর্বতের ধারেই ছিলো শবরদের বসবাস। সন্ন্যাসীর কথা শুনে নীলমাধবের দর্শণের জন্য ব্যাকূল হয়ে গেলেন রাজা। তখন সে ডেকে পাঠালেন তার পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতি কে এবং শবরদের দেশে গিয়ে খুঁজে আনতে বললেন নীলমাধবের মূর্তিকে।
রাজার আদেশ অনুযায়ী বিদ্যাপতি গেলেন শবররাজ বিশ্ববসুর নিকট। সেখানে একবার জঙ্গলের মাঝে বিদ্যাপতি পথ ভুলে যায় ।তখন তাকে উদ্ধার করেন বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। যা হবার তাই হলো , বিদ্যাপতি ললিতার প্রেমে পরে গেল। এরপর রাজা দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির মাথার মধ্যে নীলমাধবের দর্শনের চিন্তা সে প্রথম থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে অনেক বলে কয়ে ললিতা কে রাজি করালো নীলমাধবের দর্শন করানোর জন্য। কিন্তু ললিতার শর্ত ছিলো যে তিনি বিদ্যাপতিকে চোখ বেধে নিয়ে যাবেন। বিদ্যাপতি গেলেন চোখ বেধে কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলেন যব এর দানা ।
যাবার পথে ললিতার অগোচরে তিনি সেই দানা পথে ফেলতে ফেলতে ফেলেন চিহ্ন হিসেবে। নীল পর্বতে গিয়ে নীলমাধবের দর্শন পেয়ে বিদ্যাপতি ধন্য হলেন। এর পরে তিনি খবর পাঠালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। রাজা তার রথ , সৈন্য নিয়ে এলেন নীলমাধবকে নিয়ে যেতে।কিন্তু শ্রীহরির লীলা বোঝা বড় দায়। রাজা পৌঁছে গিয়ে দেখলেন যে মন্দিরে নীলমাধবের বিগ্রহ নেই। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে কোথায় বলা হয় নীল মাধবে নিজে থেকেই লীন হয়ে যান, আবার কেউ বলে থাকেন যে শবরেরা নীলমাধবের বিগ্রহ লুকিয়ে রেখে দেয়।এতদূরে এসেও নীলমাধবের দেখা না পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন হতাশ হয়ে পরেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এ জীবন সে রাখবে না। ঠিক এই সময় আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা যায়-
“সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে দারুব্রহ্ম কাষ্ঠ, সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ” (অর্থাৎ নীলমাধবের বিগ্রহ)।
এরপর রাজা চলে আসলেন তার নিজ রাজ্যে। হঠাৎ এক রাত্রে রাজা সপ্নে দেখলেন, ভগবান শ্রী হরি তাকে বলছেন –
“আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।”
রাজা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই স্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন এক খন্ড কাঠের টুকরা। হাতি সৈণ্য এনেও সেই কাঠ নড়ানো গেলো না। তখন শ্রী হরির সপ্নাদেশে খবর পাঠানো হলো শবররাজ বিশ্ববসুকে। তিনি আসার পর বিদ্যাপতি , রাজা ও বিশ্ববসু এই তিনজনে মিলে সেই কাঠের টুকরা নিয়ে এলেন রাজার প্রাসাদে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে কাঠ খোদাই করার মত ক্ষমতা কারোর ই ছিলো না ওয়ি রাজ্যে। হাতুরি বা খোদাই করতে গেলেও তা সম্ভব হলো না। ভেঙ্গে যাচ্ছে বারবার। রাজা আবার চিন্তায় পরে গেলেন। ঠিক তখনি তার কাছে এলেন অনন্ত মহারাণা নামের এক ছুতোর। অনেকের মতে শ্রীহরি নিজেই এসেছিলেন ছুতোর হয়ে আবার মতান্তরে অনেকে বলে থাকেন বিশ্বকর্মা এসেছিলেন ভগবান এর আদেশে।
সে বলল সে এই কাঠ খোদাই করে গড়ে দিবেন নীল মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু তার একটি শর্ত হলো ২১ দিনের মধ্যে কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করবে না যতক্ষন পর্যন্ত তার খোদাই এর কাজ শেষ হয়। রাজা রাজি হলে গেলেন। দরজায় পাহারা বসল। কিন্তু বিপত্তি বাধালো ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডীচা। তার আর অপেক্ষা মানছিলো না , কাজ শেষ হবার আগেই ১৪ দিনের মাথায় তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য। সেখানে নেই কোন ছুতোর, অসম্পূর্ণ অবস্থায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন। একি মূর্তি! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন, হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে রানীর মাথা ঘুরতে লাগলো।
রাজা শুনে ছুটে এলেন । রানীর উপরে ক্ষিপ্ত হলেন এবং এও বললেন শর্ত ভঙ্গের কারনে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ছুতোর চলে গেছেন।
বিমর্ষ হয়ে পরলেন রাজা। কিন্তু ভক্তের কষ্ট ভগবান সইবেন কেন। সে রাত্রেই রাজাকে আবার সপ্নে দেখা দিলেন। তাকে বললেন তিনি এই রুপেই পূজিত হবেন। তার নিজস্ব কোনো আকার বা আকৃ্তি নেই । ভক্তেরা যে রুপ কল্পনা করে তার আরাধনা করেন তিনি তার কাছে ঠিক তেমন ই। তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কে বললেন এই অসম্পুর্ন অবস্থায় ই তিনি পূজো গ্রহণ করবেন এবং তাকে পুরুষোত্তম ধামে স্থাপণ করা হয় যেন এবং সেখানেই তিনি পূজো গ্রহন করবেন।
আর এভাবেই প্রতিষ্ঠা হয় জগন্নাথ দেবের। জগন্নাথ দেবের এই রুপ নিয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
‘‘অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্’’ ।।
অর্থাৎ, তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই, অথচ সবই দেখেন। কান নাই, কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপই হলো পুরীর জগন্নাথদেব। তার পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কারণ তার রূপ তৈরিতে মানুষ অক্ষম। শুধু প্রতীককে দেখানো হয়েছে মাত্র।
জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। রথ যাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে এইটাই গল্প।
জগন্নাথের প্রধান উত্সব হল রথযাত্রা। পুরাণ অনুসারে বলা হয়- আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’ এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও (উল্টো)রথ বলা হয়।
‘রথযাত্রা’ আবার পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাবেদীযাত্রা, নন্দীঘোষযাত্রা নামেও পরিচিত।
আজকের দিনেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিন দেবতাকে টেনে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৭দিন পরে মাসির বাড়ি থেকে রথ যেখানে থাকে। সেই স্থানে আবার রথের রশি টেনে টেনে নিয়ে আসা হয় একে উল্টো রথ বা ফেরত রথ বলা হয়।