বৃষ্টির দেবতা হুদুম দেও পুজো – উত্তরবঙ্গের বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ষোড়শ শতকে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ ব্যাধ রমণী ফুল্লরার ‘বারোমাস্যা’-য় জ্যৈষ্ঠ মাসের তীব্র দাবদাহের বর্ণনা করে হয়েছে।
“পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন।
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।
পসরা এড়িয়ে জল খাত্যে যাত্যে নারি।
দেখিতে দেখিতে চিল লয় আধা সারি।
অন্ন নাহি মেলে এই পাপ জষ্ঠি মাসে।
বেঙচির ফল খেয়ে থাকি উপবাসে।”
অর্থাৎ, জ্যৈষ্ঠ মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই মাসে তাঁর ব্যবসা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে, অনেক সময় দু’টি ভাতও জোটে না, তাঁর পরিবারকে বেঙচির ফল খেয়ে দিন কাটাতে হয়।
উত্তরবঙ্গের কৃষক রমণী বিদ্ধেশ্বরী। আর সেই কৃষক রমণীদের ভরসা, ‘হুদুম দেও’। এক গভীর রাতের অন্ধকারে গ্রামের কোনও গোপন জায়গায় নারীর দল জড়ো হয় ‘হুদুম দেও’য়ের সামনে। মশাল জ্বালিয়ে তাঁরা তাঁদের নৃত্যগীতে হুদুমকে তুষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। পুরুষের চোখ এড়িয়ে নারীর দল রাতভর হুদুমকে খুশি করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাদের বিশ্বাস, হুদুম খুশি হলে বৃষ্টি নামবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাবে উত্তরবঙ্গের এই খেত-মাঠ। ফসলে ফসলে কানায় কানায় ভরে উঠবে চার দিক।
এই দেবতার পুজো পদ্ধুতি একটু অন্যরকম। পুজোর জন্য কিছুটা জায়গা আগে থেকে তৈরি করে নেওয়া হয়। সেই জায়গায় একটি গর্ত করা হয়। পুজোর জন্য কোনও এক সন্তানের মায়ের স্নানের জল, ফিঙে পাখির বাসা, গণিকার চুল, একটি কলাগাছ, জলপূর্ণ ঘট, কুলো, ধূপবাতি, নৈবেদ্য, গোটা পান-সুপারি এবং বরণডালা প্রয়োজন হয়। সেই গর্তে পুজোর উপকরণ ঢেলে দিয়ে কলাগাছ পুঁতে দেওয়া হয়। এই কলাগাছটি এক সন্তানের মাকে রাতের অন্ধকারে কেটে আনতে হয়। কলাগাছে একটি মার্কিন কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়। এই খুঁটি পোঁতার সাত দিন আগে প্রধান পূজারিনির আহ্বানে প্রতিদিন ৭-৮ জন মহিলা ‘মাগন’ করতে বেরোন। প্রধান পূজারিনি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে শব্দ করে আগে যান।
“আগ দুয়ারি কে রে
পাছ দুয়ারি কে রে
আসিছে হুদুমা দুয়ার খুলিয়া দে রে।”
বিভিন্ন বাড়ি থেকে ‘মাগন’ করে আনা সাত ঘরের জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেই গাছে।
এর পরে সবাই স্নান করে নেন। কুলোয় সেই রমণীর স্নান করা জল ঢেলে ছিটিয়ে দেওয়া হয় মেঘ দেবতার প্রতীক সেই কলাগাছটিতে, সেই জল দিয়ে তাঁকে স্নানও করানো হয়। তার পরেই বারো শস্য দিয়ে কলাগাছের নীচে ঘট স্থাপন করে ধূপ-বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ ভাবেই পুজো শেষ হলে শুরু হয় আবাহন পালা। এই নৃত্যগীতে রঙ্গ রসিকতা, অনুনয়-বিনয়, শ্লেষ-ধিক্কার, প্রেম দিয়ে হুদুমকে মোহিত করার চেষ্টায় ভরে ওঠে। এক দল নারী কলাগাছের অদূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে গান শুরু করেন। আর এক দল নারী কলাগাছের চার দিকে গোল হয়ে নৃত্য শুরু করেন। নৃত্যগীতে অধিবাস থেকে শুরু করে বিবাহ, বিরহ, মিলন, দেবতার কৃপা ভিক্ষা সব কিছুই গীত হয় মহিলাদের দ্বারা। এই নৃত্যগীতের উদ্দেশ্য হুদুম দেবতাকে খুশি করা। ওই অনুষ্ঠানে পুরুষদের অংশ গ্রহন করা অথবা দেখা, দুই-ই নিষিদ্ধ। নারীদের বিশ্বাস, যে কোনও পুরুষ ওই অনুষ্ঠানের নৃত্য দেখলে হুদুম রাগ করেন, ফলে অনাবৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। সকলে বিশ্বাস করেন হুদুম দেবতা বৃষ্টি দেন। সেই বিশ্বাসেই পুজো চালিয়ে যান বিদ্ধেশ্বরীরা।
কোচবিহার তথা গোটা উত্তরবঙ্গ এবং নমনি অসম, বাংলাদেশের রংপুর, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি বড় অংশের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘হুদুম দেও’-র পুজো প্রচলিত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অর্থকরী ফসল ধান, পাট, তামাক চাষ হয়। এই সময়ে বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন কৃষকরা। বৃষ্টি না হলে ব্যয় বহুল কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি না হলে ফসল বাঁচানো কঠিন হয়ে যেত। চাষির ঘরে নেমে আসত দুর্দশা।
“ওঠ হুদুম চৈতন হান চক্ষু মেলি চাও
আগুনে না পোড়া গেইছে মোর সর্বগাও
ওরে ম্যাঘ কালা ম্যাঘ দুইজনে সোদর ভাই
হুদুম চেতন হইছে এলা এয়াও ধুইয়া বাড়ি যাই”
— জানা যায়, হুদুমের পুজো করা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের যে কোনও শনিবার বা মঙ্গলবার। এখনও বহু গ্রামে বহু বয়স্কা মহিলার মুখে মুখে ঘোরে হুদুমের গল্প। কেউ কেউ সেই পুজোর সঙ্গীত বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। অনেকেই হদুম দেও পুজোকে ‘মেঘপুজো’ও বলে। বলা হয়, হুদুম আসলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ বা ইন্দ্র। বিবাহিত ও বিধবা মহিলারা পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। কুমারী মেয়েদের পুজোয় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।