জলপাইগুড়িতে প্রচলিত পূজার্চনা ও লৌকিক দেবতার কড়চা
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: লৌকিক সমাজে বিভিন্ন ধরনের দেবতা পূজিত হন। যেমন আঞ্চলিক দেবতা, গ্রামদেবতা, ব্রতের দেবতা, নদীদেবতা, বৃক্ষদেবতা ইত্যাদি। এইসব দেবতার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বৈদিক পৌরাণিক কাহিনী। লোকায়ত জীবনচর্যায় জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে এখনও পূজিত হন একাধিক পুরুষ দেবতা। লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার এবং পূজা-পার্বণের রীতিনীতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে লোকায়ত পরম্পরা।
কৈমারী ঠাকুর: ময়নাগুড়ির বাংলাঝাড় গ্রামের কৈমারীপাড় অঞ্চলের দেবতা কৈমারী ঠাকুর। মৃন্ময় মূর্তি, কই মাছের ওপরে এই দেবতার অধিষ্ঠান। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। বলি হয় না। তিনি জল ও জলাভূমির দেবতা। ফসলের কামনায় পুজো করা হয়।
কাজোর ঝাড় ঠাকুর: ময়নাগুড়ির অন্তর্গত ভাতিরডাঙ্গা গ্রামের পুরুষ দেবতা। মৃন্ময় মূর্তিতে পূজিত হন। মুসলমান দেবতা, বাহন ঘোড়া। হাতে বন্দুক, মাথায় টুপি, দাড়ি-গোঁফওয়ালা, পশ্চিম মুখে বিরাজমান। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে এবং মুরগি উৎসর্গ করার রীতি। জনশ্রুতি, কাজোর ঝাড় ঠাকুর গ্রামের রক্ষাকর্তা।
জোড়ধাপ ঠাকুর:
ধূপগুড়ি থানার পারকুমলাই গ্রামের গ্রামদেবতা। ‘জোড়’ অর্থ জোড়া এবং ‘ধাপ’ অর্থ উঁচু ঢিবি। পরপর দুটি উঁচু ঢিবি থাকায় স্থানটির নাম হয় জোড়ধাপ। দুটি ঢিবির মধ্যে পূর্বাংশের বড় ধাপে দোচালা টিনের ঘরে সিংহাসনে বিরাজ করেন জোড়ধাপ ঠাকুর। বাহন ঘোড়া। জনশ্রুতি, জোড়ধাপ বাবা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান এবং গ্রামকে রক্ষা করেন। তাঁর বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখ মাসে। পরবর্তীকালে কেউ কেউ ফাল্গুন মাসেও পুজো দেন। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, আঠিয়া কলা, কলার ছেরি (ঝুকি) একটা, গাঁজা এবং উৎসর্গ করা হয় পাঁঠা, পায়রা। বলি দেবার রীতি নেই। পুজোর কোনও মন্ত্র নেই।
ঢুন্ডুরা ঠাকুর: ঢুন্ডুরা জলদেবতা ও কৃষির দেবতা। ময়নাগুড়ি থানার ব্যাংকান্দি গ্রামের ঢুন্ডুরা নামক জলাশয়ের দেবতা ঢুন্ডুরা ঠাকুর। বাহন বাঘ। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। পুজো অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসে। লোকবিশ্বাস, ঢুন্ডুরা জলাশয়ে মাছ ধরতে গেলে ঢুন্ডুরা ঠাকুরকে ভক্তি করা প্রয়োজন, তা না হলে বড় বড় জোঁক ধরে বলে বিশ্বাস। বাঘের হাত থেকেও তিনি রক্ষা করেন বলে বিশ্বাস।
গাদং ঠাকুর: ধূপগুড়ি থানার গাদং এক নম্বর গ্রামে অবস্থিত গাদং ঠাকুরের থান। নদীদেবতা। গদং নদ অর্থাৎ পুরুষ দেবতারূপে পূজিত। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, সঙ্গে লাল নিশান দেবার রীতি। পুজো দেওয়া হয় আষাঢ় মাসে। এই ঠাকুরের কোনও মূর্তি নেই, পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। তিনি বিভিন্ন রোগের হাত থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস। কারও ওপর ভর করলে ভর পড়া ব্যক্তির জ্বর হয় বলে লোকের বিশ্বাস।
বেতগাড়া ঠাকুর: ময়নাগুড়ি থানার বেতগাড়া গ্রামের গ্রামদেবতা বেতগাড়া ঠাকুর। বেত অর্থাৎ বেতের গাছ এবং ‘গাড়া’ অর্থ নিচু জলাভূমি। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। আষাঢ় মাসে বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, বেতগাড়া ঠাকুরকে ফসলের কামনায় পুজো দেওয়া হয়।
ধওলাগুড়ি ঠাকুর: ময়নাগুড়ির ধওলাগুড়ি গ্রামের গ্রামদেবতা ধওলাগুড়ি ঠাকুর। ‘ধওলা’ শব্দের অর্থ সাদা বা ফর্সা। তিনি সাহেব দেবতা; জনৈক ইংরেজ সাহেবের আস্তানা ছিল এখানে। একদা মৃন্ময় মূর্তিতে পুজো হত। শার্ট, স্যুট পরিহিত সাহেব দেবতা; বাহন ঘোড়া। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা।
কাঠুয়া ঠাকুর: ময়নাগুড়ি থানার অন্তর্গত বর্ধিষ্ণু গ্রাম ব্যাংকান্দি। মূলত রাজবংশী মানুষেরই বসবাস ছিল এই অঞ্চলে। এই গ্রামে কাঠুয়া ঠাকুরের থানে আছে একটি পাথরের চৌবাচ্চা, মাটির তলায় পাওয়া যায় ইট এবং বিভিন্ন আকৃতির প্রস্তরখণ্ড। এই দেবতার প্রতীক পাথর বা শিলাখণ্ড। ফসলের কামনায় কাঠুয়া ঠাকুরকে পুজো করা হত। কোনও মন্ত্র নেই। লোকবিশ্বাস, তিনি জাগ্রত দেবতা, তাঁর বাহন ঘোড়া। জানা যায়, কাঠুয়া ঠাকুর সম্ভবত পূর্বপুরুষ দেবতা থেকে গ্রামদেবতায় রূপান্তরিত। পুজোর নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। পুজো উপলক্ষে বলি বা উৎসর্গ করা হত শূকর। প্রতি বছর পয়লা অগ্রহায়ণে বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হত।
নলডোবা ঠাকুর: জল-জলাভূমির দেবতা নলডোবা ঠাকুর। ফসলের কামনায় তাঁর পুজো করে রাজবংশী সমাজ। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। ময়নাগুড়ি থানার অন্তর্গত মাধবডাঙ্গা গ্রামের ভুসার বাড়ির গ্রামদেবতা নলডোবা ঠাকুর। পুজোর নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। লোকবিশ্বাস, নলডোবা ঠাকুর জোতদার ঠাকুর। গ্রামদেবতা এবং পূর্বপুরুষ দেবতা। পূজার্চনা করা হয় আষাঢ় মাসে এবং কার্তিক মাসে। লোকবিশ্বাস, তিনি মুসলিম দেবতা বা পির দেবতা। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা, সুরা, গাঁজা। উৎসর্গ করা হয় মুরগি। বাৎসরিক পুজো হয় আষাঢ় মাসে।
পুলকুড়া: ময়নাগুড়ি থানার দক্ষিণ বড়গিলা গ্রামে পুলকুড়া ঠাকুরের থান। ইনি কুড়া বা জলাশয়ের দেবতা। জনশ্রুতি, ইনি সাহেব দেবতা, পরনে সাহেবের মতো প্যান্ট-শার্ট, বাহন ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে তিনি ঘুরে বেড়ান। জানা যায়, কোনও সময় কুড়ার পাশেই ভুটিয়া ও ইংরেজদের আস্তানা ছিল। জনৈক ইংরেজ সাহেব দেবায়িত হয়ে গ্রামদেবতায় রূপান্তরিত হন। সাধারণত পাথর বা শিলাখণ্ড এই দেবতার প্রতীক। মানত থাকলে কেউ কেউ মৃন্ময়মূর্তিতে তাঁর পুজো করেন। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। উৎসর্গ করা হয় পায়রা, মুরগি। বাৎসরিক পুজো হয় আষাঢ় মাসে। পুজোর কোনও মন্ত্র নেই।
ঝুমুর ঠাকুর: ধূপগুড়ি থানার অন্তর্গত গ্রাাম ডাঙ্গাপাড়া। এই গ্রামের নদীদেবতা ও গ্রামদেবতা ঝুমুর ঠাকুর। আষাঢ় মাসের গচিবুনা বা গচুকুনা ধান রোপণের নির্দিষ্ট দিনে পুজো অনুষ্ঠিত হয়। নৈবেদ্য দুধ, কলা এবং গাঁজা। বন্যায় যাতে ফসল নষ্ট না হয় এবং ফসল পাওয়া যায় সেই কামনায় এই দেবতার পুজো করা হয়।
জ্যাম্প সাহেব:
ধূপগুড়ি থানার বাবুপাড়ার গ্রামদেবতা জ্যাম্প সাহেব। শোনা যায়, পশ্চিম ডুয়ার্সে একদা ভুটিয়াদের আনাগোনা ছিল এবং জ্যাম্প সাহেব আসলে ভোট দেবতা। ইংরেজদের দ্বারা অধিকৃত হওয়ার পরে ‘সাহেব’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। বাহন ঘোড়া। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, সুরা এবং গাঁজা। উৎসর্গ করা হয় মুরগি। লোকবিশ্বাস অনুসারে ইনি প্রজননেরও দেবতা। ফসলের কামনায়, সন্তানকামনায় পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
মেচ রাজা ঠাকুর: মেচ রাজা কৃষি উর্বরাতন্ত্রের দেবতা এবং গ্রামের রক্ষাকর্তা। লোকবিশ্বাস, বিভিন্ন রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করেন এই দেবতা। ধূপগুড়ি থানার বাবুপাড়ার একক গ্রামদেবতা মেচ রাজা। জনশ্রুতি, অতীতে মেচ রাজা ঠাকুরের একক থান ছিল, বর্তমানে মেচের থান বা মেচ রাজার গারাম থানে পুজো দেওয়া হয়। বাহন সাপ এবং বাঘ। জানা যায়, মেচ রাজার সঙ্গে বিরাজ করেন একজন সিপাই, মেচ রাজার সঙ্গে তাঁরও পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মেচ রাজার সঙ্গে থাকত একটি সোনার কলা গাছ। পুজোর নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। বলি হয় পাঁঠা, পায়রা। লোকবিশ্বাস, মেচ রাজা অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা। বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় জ্যৈষ্ঠ মাসে।
ঠুমকির ঝাড় ঠাকুর: ইনি জঙ্গলের দেবতা। জানা যায়, বাঘের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই দেবতার পূজার্চনা করা হত। ধূপগুড়ি থানার মধ্য ডাউকিমারী গ্রামের ঠুমকির ঝাড় এলাকার গ্রামদেবতা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, থানের পাশে কোনও জমিতে হলকর্ষণ করলে অতীতে সোনার গয়না লাঙলের ফালে উঠে আসত। এই দেবতার বাহন বাঘ। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। বলি হয় পাঁঠা, পায়রা। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসে।
পঠুয়াডাঙি ঠাকুর: ময়নাগুড়ি থানার অন্তর্গত চাত্রাপাড় গ্রামের গ্রামদেবতা। তিনি পির ঠাকুর, বাহন ঘোড়া। থানের পাশের বিলে মাছ ধরতে হলে পঠুয়াডাঙি ঠাকুরকে মানত করার রীতি। তিনি জলাশয়েরও দেবতা। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা। বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে। লোকবিশ্বাস, কোনও মানুষ অন্যায় করলে তার ওপরে দেবতা ভর করেন, তারপরে থানে পুজো দিলে ভরে পড়া ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ডাঙিকুড়া ঠাকু্র: ময়নাগুড়ি থানা চাত্রাপাড় গ্রামের কুড়া বা জলাশয়ের দেবতা ডাঙিকুড়া ঠাকুর। শোনা যায়, ডাঙি সাহেব জনৈক ব্যক্তি কুড়ার পাশে বসবাস করতেন এবং পরবর্তীকালে তিনি দেবায়িত হয়ে যান। এই লোকদেবতার বাহন ঘোড়া। বাৎসরিক পুজো হয় আষাঢ় মাসে। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে এবং কালো মুরগি। লোকবিশ্বাস, এই দেবতা অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা।। ভর করা ব্যক্তির ডায়েরিয়া, বমি ইত্যাদি হতে পারে। পরে মানত করলে সে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ঢোলমগর: ময়নাগুড়ি থানার চাত্রাপাড় গ্রামের গ্রামদেবতা। রাজবংশী সমাজে মগর ভয়ঙ্কর দেবতা। কবন্ধের মতো, মাথা নেই এবং বুকে দুটি চোখ। লোকবিশ্বাস, যেকোনও সেতু অথবা নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকেন, বুকে দুই চোখ মশালের মতো জ্বলজ্বল করে। মগর দেবতার তিনটি রূপ— কাটামগর, জাতিমগর এবং ঢোলমগর। জাতিমগরকে স্থানবিশেষে বলা হয় চনমগর। ঢোলমগরের বাহন ঘোড়া। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা, সঙ্গে একটি লাল নিশান দেবার রীতি। ঢোলমগর কারও ওপর ভর করলে ডায়েরিয়া এবং বমি হতে পারে বলে বিশ্বাস।
ভৈইসপোতা ঠাকুর: ময়নাগুড়ি থানার চাত্রাপাড় গ্রামের গ্রামদেবতা ভৈইসপোতা ঠাকুর। ভৈইস বা মোষ কোনও একসময় থানের পাশে পুঁতে রাখা হয়েছিল বলে ভৈইসপোতা নাম হয়েছে। লোকবিশ্বাস, সেই মহিষটি পরবর্তীকালে গ্রামদেবতায় রূপান্তরিত। বাহন মোষ। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে।
চামার ঠাকুর: ময়নাগুড়ি থানার চূড়াভাণ্ডার গ্রামের গ্রামদেবতা চামার ঠাকুর। তিনি পির দেবতা। গ্রামে কারও বাড়িতে নতুন গাই বিয়োলে বা বাছুর জন্ম নিলে প্রথমে চামার ঠাকুরকে পুজো দেবার নিয়ম, তা না হলে চামার ঠাকুর বাছুর লুকিয়ে রাখেন বলে বিশ্বাস। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা। মৃন্ময় মূর্তি নেই, মাটির থাপনা তাঁর প্রতীক। সারাবছর যেকোনও সময় পুজো দেওয়া যেতে পারে।
কেশুরডোবা ঠাকুর : দক্ষিণ বড়গিলা গ্রামের দিঘি বা জলাশয়ের দেবতা কেশুরডোবা ঠাকুর। বাহন জোঁক; পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। আষাঢ় মাসে ধান রোপণের আগে ফসলের কামনায় কেশুরডোবা ঠাকুরকে পুজো দিতে হয়। তিনি মূলত ভয়ভীতির দেবতা, কৃষির দেবতা।
ধনতলা ঠাকুর: জলপাইগুড়ির মালকানী গ্রামের গ্রামদেবতা ধনতলা ঠাকুর। জনশ্রুতি, তিস্তার বন্যায় জনৈক ধনবান ব্যক্তির ধনসম্পত্তি কুড়ায় তলিয়ে যায়, সেই বিশ্বাস থেকেই গ্রামদেবতার নাম ধনতলা। পাথর বা শিলাখণ্ড দেবতার প্রতীক। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে।
গিরিয়া ঠাকুর: ময়নাগুড়ির উত্তর খাগরাবাড়ি গ্রামের (পুরাটুর বাড়ি) নালার দেবতা গিরিয়া ঠাকুর। রাজবংশী ভাষায় গিরিয়া অর্থ নালা। বাহন ঘোড়া, নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে। বৈশাখ মাসে পুজো দেবার রীতি। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। তিনি জলদেবতা, কৃষিদেবতা এবং গ্রামদেবতা।
কানাইয়া ঠাকুর: চাপগড় গ্রামের দেবতা কানাইয়া ঠাকুর। তিনি মৃন্ময় মূর্তিতে পূজিত। ঝাঁকড়া চুল, পরনে বাঘছাল এবং হাতে মাছ ধরার ছিপ। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা, খই। আষাঢ় মাসে কানাইয়া ঠাকুরের পুজো দেবার রীতি। তিনি কৃষির দেবতা; লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কারে প্রজননেরও দেবতা।
গুয়াবাড়ি ঠাকুর: মাল থানার ঝাড় মাটিয়ালী গ্রামের গুয়াবাড়ি নামক স্থানের গ্রামদেবতা গুয়াবাড়ি ঠাকুর। বাহন ঘোড়া। পূজার নৈবেদ্য দুধ, কলা। শোনা যায়, পুজোয় বিশেষ রীতি হল পুজো দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় পেছনে ফিরে তাকানো নিষেধ।
চোদ্দোটাকিয়া: উত্তর কালামাটি এবং কাউয়াকাব (সিঙিভাণ্ডানী) গ্রামের পূর্বপুরুষ দেবতা এবং গ্রামদেবতা চোদ্দোটাকিয়া। মৃন্ময় মূর্তিতে পূজিত; বাহন ঘোড়া। মাঘ-ফাল্গুন মাসে পুজো দেয় স্থানীয় রাজবংশী সমাজ। নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। পুজোয় বলি হয় পাঁঠা, পায়রা এবং একটি মুরগি উৎসর্গ করার রীতি। লোকবিশ্বাস, তিনি জাগ্রত দেবতা। গ্রামের রক্ষাকর্তা।
ধদ্ধরা ঠাকুর: ধদ্ধরা শব্দের অর্থ স্রোতধারা বা ছোট নদী। গড়ালবাড়ি গ্রামের চৌধুরিপাড়ার গ্রামদেবতা আসলে নদীদেবতা, জলদেবতা। শিবজ্ঞানে পুজো করে রাজবংশী সমাজ। বাহন বাঘ। পুজোর নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, আঠিয়া (বিচি) কলা। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে ফসলের কামনায়, বৃষ্টির কামনায় পুজো অনুষ্ঠিত হয় ।
রাঙা ঠাকুর: রাজগঞ্জ থানার জহুরি তালমা গ্রামের গ্রামদেবতা রাঙা ঠাকুর। বাহন বাঘ। পুজোর নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। লোকবিশ্বাস, দেবতার গাত্রবর্ণ লাল, তাই দেবতার নাম রাঙা ঠাকুর। বিভিন্ন অসুখবিসুখের হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করেন। কেউ কেউ শিবজ্ঞানে এই দেবতার পুজো দেন।
জামুবাড়ি ঠাকুর : ধূপগুড়ি থানার পশ্চিম মল্লিকপাড়া গ্রামের গ্রামদেবতা জামুবাড়ি ঠাকুর। মাটির থাপনা তাঁর প্রতীক, বাহন বাঘ। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। বাৎসরিক পুজো হয় আষাঢ় মাসে। তিনি কৃষির দেবতা এবং গ্রামদেবতা।
ঘোকমাগছ ঠাকুর: বানিয়াপাড়া গ্রামে পূজিত হন ঘোকমাগছ ঠাকুর। পাথর বা শিলাখণ্ড তাঁর প্রতীক। নৈবেদ্য দুধ, কলা।
ডোম ঠাকুর: মোহন্তপাড়ার গ্রামদেবতা ডোম ঠাকুর। বাহন শূকর। পূজার নৈবেদ্য দই, চিঁড়ে, কলা। একটি মোরগ পুজোর সময় উৎসর্গ করার রীতি।