বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

১৯০২-এর, ৪ জুলাই কেমন ছিল স্বামীজির চলে যাওয়ার দিন?

July 4, 2023 | 5 min read

সৌভিক রাজ

১৯০২-এর, ৪ জুলাই কেমন ছিল স্বামীজির চলে যাওয়ার দিন?

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ৪ জুলাই সকাল এগারোটা নাগাদ অন্যান্য দিনের মতোই কাজকর্ম চলছিল বেলুড় মঠে। ঠাকুরঘরে ধ্যানে বসেছিলেন স্বামীজি। স্বামীজির তখন শান্ত, ধ্যানপর্ব সমাধা হলে শুরু করলেন গান। সেদিন সকালে বেলুড়ের ঘাটে জেলেদের নৌকা ভিড়েছিল। প্রচুর ইলিশ উঠেছিল। শোনা যায়, ইলিশের ঝাল-ঝোল-অম্বলের মতো পদ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন স্বামীজি। দুপুরের খাওয়ারের পর লাইব্রেরিতে গেলেন, সঙ্গী প্রেমানন্দকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন বেলুড় বাজার পর্যন্ত। মঠে ফিরে সন্ধ্যা সাতটার আরতির পর ফের ধ্যানের ঘরে ঢুকলেন, কিছুক্ষণ পর স্বামীজির ঘর থেকে সাড়া এল, গরম লাগছিল তাঁর। জানলা খুলে দেওয়া হল। সঙ্গী ব্রজেন্দ্র স্বামীজির পা টিপে দিতে শুরু করলেন। এরপর রাত ন’টার পরই সব কিছু বদলে যেতে শুরু করল। স্বামীজির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল; কিন্তু মুখে কথা নেই।

ছবি: স্বামী বিবেকানন্দ

রাত ৯টা ১০মাথা বালিশ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল দেহ, সব নিস্তব্ধ! মুখে হালকা হাসি লেগে আছে। সন্ন্যাসী গুরুভাইরা মনে করলেন, ভাবসমাধি হয়েছে হয়ত। চলল শ্রীরামকৃষ্ণের নাম গান। আরও কিছুক্ষণ কোন সাড়া না মেলায় বেলুড় থেকে এলেন ডাক্তার মহেন্দ্র মজুমদার, বৈকুন্ঠনাথ সান্যাল। কলকাতায় থাকা স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দের কাছে খবর গেল, তাঁরাও চলে এলেন। ডাক্তারের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দেহ রাখলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

ছবি: স্বামী বিবেকানন্দ

শুক্রবার ৪ জুলাই ১৯০২ এর ঘটনাক্রম একটু বলি, ওইদিন খুব ভোরে উঠে উপাসনার জন্য মন্দিরে গিয়েছিলেন স্বামীজী। প্রাতঃরাশে দুধ ও ফল খেলেন। সকলের সঙ্গে হাসি মজা হল, সেদিন গঙ্গার ইলিশ কেনা হল। তারপর মর্নিং ওয়াক। সকাল ৮.৩০, স্বামী প্রেমানন্দকে ঠাকুরের শয়নঘরে তাঁর আসন করে দিয়ে, চারদিকের দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। বেলা ১১টা, ধ্যানভঙ্গের পরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে স্বামীজি নিজের হাতে ঠাকুরের বিছানা ঝেড়ে দিলেন। ১১.৩০ টার সময়ে আনন্দে করে সকলের সঙ্গে একত্রে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা, অম্বল দিয়ে ভাত খেলেন। বললেন, একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি অনেক কষ্টে। দুপুর ১২.৩০তে পনেরো মিনিট ঘুমিয়েই স্বামী প্রেমানন্দকে নিয়ে সঙ্গে স্বামীজি ছুটলেন পড়তে। বললেন, সন্ন্যাসী হয়ে দিবানিদ্রা পাপ, চল পড়ি গিয়ে। বেলা ১.৩০-এ লাইব্রেরি ঘরে সাধু-ব্রহ্মচারীদের পাণিনীর ব্যাকরণ পড়ালেন। বিকেল ৪-তে এক কাপ দুধ খেয়ে বাবুরাম মহারাজকে নিয়ে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গেলেন। প্রায় দুমাইল ভ্রমণ করলেন, সে সময় এতটা হাঁটতেন না কিন্তু সেদিন হাঁটলেন। বেদ এবং বেদবিদ্যালয় আলোচনা করলেন। বিকেল ৫টা, স্বামীজি মঠে ফিরলেন। তামাক খেয়ে শৌচকর্ম সেরে এসে বললেন, আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি না। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় স্বামীজি এককাপ চা চাইলেন।

ছবি: স্বামী বিবকানন্দ


সন্ধ্যা ৭.০৫-এ, সন্ধ্যা ঘণ্টা বাজতেই স্বামীজি নিজের ঘরে চলে গেলেন, সঙ্গে ব্রজেন্দ্র। ধ্যান শুরুর আগে ব্রজেন্দ্রকে বললেন, যতক্ষণ না ডাকি, অন্য ঘরে গিয়ে জপ, ধ্যান কর। সন্ধ্যে ৭.৪৫-এ স্বামীজি ব্রজেন্দ্রকে বললেন, গরম বোধ হচ্ছে, জানলা খুলে দাও। মেঝেতে শুয়ে পড়লেন, হাতে জপমালা। খানিক পরে বললেন, আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দিতে বললেন। রাত ৯.০০ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে বাম পাশ ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর ডান হাত একটু কাঁপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফোঁটা জমল। রাত ৯.০২ থেকে ৯.১০, গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। মিনিট দুই পরে আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস, একটু নড়ে উঠে মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি। ৯.২০ যোগেন বুড়ো গোপালদাকে ডেকে আনলেন।

ডাঃ মজুমদার থাকতেন নদীর ওপারে বরাহনগরে, তাঁকে ডাকা হল, আর প্রেমানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ স্বামীজির সমাধি ভাঙাবার জন্য তাঁর কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন। রাত ১০.৩০ বেলুড় মঠে এসে ডাক্তার মজুমদার দেখলেন, নাড়ি বন্ধ এবং কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচলের ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুরু হল। রাত বারোটায় ডাক্তার বলেদিলেন, স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। পরের দিন সকাল, ৫ জুলাই শনিবার দেখা গেল স্বামীজির দুটো চোখ জবাফুলের মতো লাল, নাকমুখ দিয়ে অল্প অল্প রক্ত বেরিয়েছে। ডাক্তার বিপিন ঘোষ বললেন সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ। যদিও মহেন্দ্র ডাক্তার বলে গিয়েছেন হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়াই দেহাবসানের কারণ।

ছবি: স্বামী বিবকানন্দের পাদুকা জোড়া

ভুবনেশ্বরী দেবী খবর পেয়েছিলেন সকালে। ভগ্নীপতিকে নিয়ে ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ বেলুড় মঠে এলেন, কিছুক্ষণ পরে কাঁদতে কাঁদতে এলেন জননী ভুবনেশ্বরী, তাঁর সঙ্গে দৌহিত্র ব্রজমোহন ঘোষ। সকাল সাতটাতেই নিবেদিতা এসে গিয়েছিলেন, তারপর নির্বাক হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত-পাখায় স্বামীজিকে হাওয়া করেছিলেন। সন্ন্যাসীরা এক সময়ে বিবেকানন্দ জননীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। চিতাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হতে একটু সময় লেগেছিল, বিকাল চারটের সময় শুরু হল দাহকার্য। শেষ হয় শনিবার সন্ধ্যা ছটায়।

তবে এক ঘটনার কথা না বললেই নয়, ৪ ঠা জুলাই, ১৯০২ সালের রাতে নিবেদিতা স্বপ্ন দেখলেন, শ্রী রামকৃষ্ণ যেন সে রাতে আবার দেহ ত্যাগ করছেন। পরের দিন ভোরেই বেলুড় মঠ থেকে স্বামী সারদানন্দের লেখা চিঠি নিয়ে একজন সন্ন্যাসী এলেন নিবেদিতার কাছে। স্বামীজির মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। নিবেদিতার সামনে তখন চারিদিক শূন্য। শুধুই আঁধার। ছুটলেন বেলুড় মঠে, স্বামীজির ঘরে গিয়ে দেখলেন মেঝের মধ্যে শুয়ে আছে রাজা…হ্যাঁ তিনি রাজাই। মহারাজও একি সাজে, স্বামীজি এই প্রথম বিশ্রাম নিচ্ছেন, একটি পাখা নিয়ে গুরুর মাথার কাছে বসলেন নিবেদিতা।তখন তিনি যেন জননী আর গুরু তাঁর পুত্র। নীরবে হাওয়া করে যেতে লাগলেন নিবেদিতা। ৫ই জুলাই অর্থাৎ ঐ দিনই দুপুরে গেরুয়া বস্ত্রে ঢাকা স্বামীজির দেহে নিয়ে আসা হল সৎকারের জন্যে। তাঁর মনে হল ওই বস্ত্রটি তিনি যদি পেতেন।

সারদানন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন ঐ বস্ত্রটি কী আগুনে দেওয়া হবে। সারদানন্দ ওঁর মনে অভিপ্রায় উপলব্ধি করে বললেন, ইচ্ছে হলে তিনি নিতে পারেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না শোভন হবে কি না, তাই আর রাজি হলেন না। শুরু হল পঞ্চভূতে মেশা, পিতার জ্বলন্ত চিতার দিকে যেনো তাকিয়ে বসে রইলেন সর্বশান্ত কন্যা হয়ে। সন্ধ্যে ছটা, চিতার আগুন প্রায় নিভে এসেছে, স্বামীজির দেহ আসতে আসতে মিশে যাচ্ছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোমের মধ্যে। হঠাৎ নিবেদিতার মনে হল কেউ যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিচ্ছে, নিবেদিতা দেখলেন বস্ত্রখন্ডের একটি টুকরো তাঁর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। তিনি পরম যত্নে গুরু শেষ চিহ্ন তুলে নিলেন। পার্থিব জীবনে শেষ হল বিবেকানন্দ অধ্যায়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#yugpurush swami vivekananda, #Swami Vivekananda, #death anniversary, #Swamiji

আরো দেখুন