প্রায় ৪০০ বছর ধরে শান্তিপুরে চলে আসছে বাংলার প্রথম দক্ষিণা কালী পুজো
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: শান্তিপুরে বিখ্যাত আগমেশ্বরী কালী পুজো৷ প্রায় ৪০০ বছর ধরে এই পুজো চলে আসছে। পুরনো রীতি মেনে কার্তিক অমাবস্যায় আগমেশ্বরী কালীর পুজো হয় ৷ বিখ্যাত পন্ডিত শাক্তসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম নিজ হাতে দক্ষিণা কালীর মাটির মূর্তি তৈরী করে পুজো করেন৷
কথিত আছে, “নবদ্বীপের আগমেশ্বরী মাতা ” বাংলার প্রথম পূজিত দক্ষিণা কালী। প্রায় চারশো বছর আগে সাধক মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মায়ের আদেশ অনুসারে সকালে উঠে ভোরে বাইরে দেখেন এক গোপ বধূ দেওয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছেন ৷ যাঁর উদ্ধার্ঙ্গ অনাবৃত ৷ এলো চুল ৷ ঠাকুর মশাইকে হঠাৎ দেখে ঐ মহিলা লজ্জায় জিভ কাটেন ৷ বিব্রত গোপ বধূ নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করতেই স্বল্পবাসটুকুও খসে যায় ৷ এই রূপটিকেই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়লেন ইষ্টদেবী কালিকার অধরা রূপ ৷ দেবী ঘোর কৃষ্ণবর্ণা , তাঁর আলুলায়িত কেশদাম ৷ গোবরের তাল ধরা ডান হাতটি হলো বরাভয় মুদ্রা ৷ সাধক বাঁ হাতে দিলেন খড়্গ ৷ বধূর সিঁদুর হলো মায়ের তৃতীয় নয়ন৷ ঐ মহিলা টিলার উপর ডান পা রেখেছিলেন সেটাই সাধকের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিতে হলো শব রূপী শিবের বুক ৷ মহাকালের উপর দন্ডায়মানা চতুর্ভুজা মা কালী ৷ সেই থেকে আজও সর্বত্র পূজিত হচ্ছেন আগমবাগীশের কল্পিত দক্ষিণা কালী ৷
এখানে একদিনে মূর্তির রঙ এবং চক্ষুদান হয়ে পুজো হয় এবং পরদিনই দেবী প্রতিমা বিসর্জিত হয়৷ এখনও সেই ধারা অব্যাহত৷ আগমবাগিশের প্রতিষ্ঠিত বলেই তাঁর নাম অনুসারে মায়ের নাম হয় আগমেশ্বরী। প্রতিবছর বিজয়া দশমীতে এই পুজোর সূচনা করা হয়। পুজোর আগের দিন থেকে প্রতিমার গায়ে খড়িমাটি করা হয় ও পুজোর দিন সকাল থেকে রঙের কাজ শুরু হয়৷ একদম শেষে হয় চক্ষুদান৷ পুজো শুরুর মুহূর্তে সোনা ও রুপোর অলংকারে সাজিয়ে তোলা হয় প্রতিমাকে৷ এরপরই শুরু হয় পুজো।
এই প্রতিমার উচ্চতা প্রতিবারই প্রায় ২০ ফুট থাকে। এই পুজো দেখতে ভিড় জমান বহু দূর-দূরান্তের মানুষ। পুজোর পরের দিন প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়৷ সেই দৃশ্য দেখতে গোটা শান্তিপুর শহরের রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়ে মানুষের ঢল।
পুজো পরিষদের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সত্যনারায়ণ গোস্বামীর দাবি, ‘‘স্বপ্নে তিনি নির্দেশ পেয়েছিলেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাকে দেখবেন সেই রূপেই মূর্তি গড়তে৷ সেইমতো তিনি ঘুম থেকে উঠে একটি কালো মেয়েকে ঘুঁটে দিতে দেখেন এবং তাঁকে দেখে লজ্জায় সেই মেয়ে জিভ কেটেছিল৷ তিনি তৎক্ষণাৎ গঙ্গা থেকে মাটি এনে ওই রূপেই মূর্তি গড়ে সেদিনই বিসর্জন দিয়েছিলেন৷’’ তিনি জানান, কৃষ্ণপক্ষের শুরু দিন পাঠখিলান অনুষ্ঠান হয়৷
জানা যায়, নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি ঈশান চন্দ্র ও জমিদার এবং সাধকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালী পুজো ব্যাপকতা লাভ করে ৷ সাধক রামপ্রসাদ , রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব , বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ কৃষ্ণানন্দের পদ্ধতিতেই কালী পুজো করেছিলেন৷ কালী পুজোর মধ্যে দিয়ে তিনি মনে করতেন আমাদের ষড়রিপু -কাম, ক্রোধ, মোহ, মায়া ,লোভ ও মাৎসর্যকে জয় করা যায় ৷ চৈতন্য গ্রন্থে কালী পুজো সম্বন্ধে লেখা আছে –
“যত পড়ে গঙ্গাবাস পন্ডিতের স্থানে,
সভারেই ঠাকুর চালেন অনুক্ষণে ৷
শ্রীমুরারী গুপ্ত শ্রীকমলাকান্ত নাম ৷
কৃষ্ণানন্দ আদি যত গোষ্ঠীর প্রধান ৷৷”
“দেবী প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ , প্রসীদ মাতর্জগতোহখিলস্য৷
প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী পাহি বিশ্বং, ত্বমীশ্বরী দেবী চরাচরস্য৷”
“করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্ কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষিতাম্ ৷”