IPC-র হিন্দি নামকরণ বেআইনি? কী বলছেন আইনজ্ঞরা?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: নামবদলের নেশায় মশগুল বিজেপি সরকার, রাস্তা-ঘাট, নগর জনপদের পর নাম পরিবর্তনের গেরো থেকে রেহাই পাচ্ছে না দণ্ডবিধিও। দেশের ফৌজদারি বিচার পরিকাঠামোর নিয়ন্ত্রণক আইনগুলির নাম বদল করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ১১ আগস্ট সংসদে তিনটি নতুন বিল পেশ করেছিলেন।
মোদী সরকার ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-কে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ২০২৩, কোড অফ ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর, ১৯৭৩-কে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ২০২৩ এবং ইন্ডিয়ান অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-কে ভারত সাক্ষ্য আইন, ২০২৩ -র মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করেছে। তিনটি বিলই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। নয়া বিল অনুযায়ী এবার থেকে আইনগুলির নাম হবে হিন্দি ভাষায়। এই ঘটনায় হিন্দি আগ্রাসনের অভিযোগ এনে সরব হয়েছে দ্রাবিড় মুনেত্র কাজহগম পার্টি। তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন দল ডিএমকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে, হিন্দি-শিরোনামের বিলগুলির মাধ্যমে দেশের অহিন্দিভাষী অংশগুলিতে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার। হিন্দি শিরোনামের বিলগুলিকে সংবিধানের পরিপন্থী, বেআইনি এবং নজিরবিহীন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডিএমকে সভাপতি এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন অভিযোগ করেছেন মোদী সরকার ভারতের বৈচিত্র্যে আঘাত আনছে। বিজেপির এই হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা হবে। ডিএমকে রাজ্যসভার সাংসদ তথা প্রবীণ পি উইলসন তিনটি বিলের হিন্দি শিরোনাম পরিবর্তন করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ ভারতীয় আইনজীবীরা এই নামগুলি উচ্চারণ করার চেষ্টা করে আদালতে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছেন। তিনি সংবিধানের ৩৪৮ নম্বর ধারার উল্লেখ করেছেন। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদে পাশ হওয়া সমস্ত আইনের টেক্সট ইংরেজি ভাষায় হতে হবে। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর, এই বিলগুলিকে মোদী সরকারের হিন্দি অরাজকতা বলে উল্লেখ করেছেন।
সংবিধানের ৩৪৮ নম্বর ধারার লঙ্ঘন হচ্ছে কোথায়? কীভাবে?
আইনজীবী কেএস চৌহানের মতে, একচেটিয়াভাবে আইনগুলির হিন্দি শিরোনাম থাকা সংবিধানের ৩৪৮ ধারার পরিপন্থী। সংবিধান অনুমোদিত নয়৷ তাঁর মতে বিলগুলিকে আইন হিসাবে প্রণয়ন করা হলে; ফল অতিভয়ঙ্কর হতে পারে। সংবিধান স্থিতিস্থাপক নয়, এমন আইনের শিথিলতা নেই ভারতীয় সংবিধান। আইন কখনওই আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হতে পারে না। আরেক প্রবীণ আইনজীবী, মোহন কাতরকিও সহমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ৩৪৮ অনুচ্ছেদ নির্দেশ করে সমস্ত সংসদীয় আইনের অনুমোদিত পাঠ্য অবশ্যই ইংরেজিতে হতে হবে, আইনের শিরোনামও ইংরেজি ভাষায় থাকবে।
তিনি আরও জানান ফৌজদারি আইন ও ফৌজদারি পদ্ধতিকে সংবিধানের সপ্তম তফসিলে রাখা হয়েছে, যার অর্থ সংসদ এবং রাজ্য আইনসভা উভয়ই, এই বিষয়ে আইন করতে পারে, অর্থাৎ প্রতিটি রাজ্যই নিজস্ব স্থানীয় ভাষায় বিলগুলির নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারে। যা রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা ডেকে আনতে পারে।
আরেক অভিজ্ঞ আইনজীবী, রেবেকা এম জনের মতে, ৩৪৮ ধারা অনুসারে, সমস্ত কেন্দ্রীয় আইনের ভাষা ইংরেজিতে হওয়া উচিত। হিন্দি শিরোনামসহ অন্য কোনও কেন্দ্রীয় আইন মনেই করতে পারছেন না আইনজীবীরা। আইনজীবী ও আইন বিষয়ক শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক জি মোহন গোপালের কথায়, হিন্দি শিরোনামযুক্ত বিলগুলির হিন্দি সংস্করণে কোনও আইনি বাধা নেই। বিলগুলিতে আঞ্চলিক ভাষার শিরোনামসহ আঞ্চলিক ভাষার সংস্করণও থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বিলগুলির ইংরেজি শিরোনাম নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজি শিরোনাম বাদ দেওয়াকে হিন্দি জাতীয়তাবাদের আগ্রাসন বলে উল্লেখ করছেন তিনি। যা দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের জন্য অপমানজনক এবং দেশের ঐক্যের জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে করেছেন অধ্যাপক।
এছাড়াও শিরোনামে বিভ্রান্তি রয়েছে। তিনি বলেন, তিনটি বিলের মধ্যে দুটির শিরোনাম ভুল। তাঁর মতে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা এবং ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা উভয়ই ভুল। সংস্কৃতে ‘ন্যায়’ হল যুক্তি যা ন্যায়বিচারের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। দণ্ডনীয় অপরাধ নির্ধারণের আইনের নাম কী করে ‘ন্যায় সংহিতা’ হয়? প্রশ্ন তুলছেন বলেন। ন্যায় সংহিতা যেকোনও আইনের সঙ্গেই মানানসই হতে পারে, কারণ প্রতিটি আইন ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যেই প্রণয়ন করা হয়।
ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, আক্ষরিক অর্থে ইংরেজি অনুবাদ করলে হবে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা কোড। অধ্যাপক গোপালের মতে, এটিও ভুল। বিলের বিষয়বস্তু ফৌজদারি পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা সুরক্ষা এবং সুরক্ষার একটি দিক মাত্র। অন্যান্য অনেক আইনই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুরক্ষা এবং সুরক্ষার অন্যান্য বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা শিরোনামটি পর্যাপ্তভাবে সুরক্ষা এবং সুরক্ষার নির্দিষ্ট দিককে নির্দেশ করে না, যা অন্যান্য আইন থেকে স্বতন্ত্র। তিনি দুটি বিলের শিরোনামকে অযৌক্তিক বলছেন, কারণ তাদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিরোনামের যুক্তিসঙ্গত সম্পর্ক নেই।