প্রাচীন পুরাণ থেকে একবিংশ শতাব্দী- কালজয়ী মা শীতলার ইতিকথা
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: শীতলা নিতান্তই গ্রামীন দেবী নন, গোটা ভারতে তিনি পূজিত। স্কন্দপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মতো কয়েকটি প্রাচীন পুরাণে শীতলার কথা উল্লেখ রয়েছে, সেখানে তাঁকে গুটিবসন্তের নিয়ন্তা হিসেবে। যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁর সৃষ্টি, এবং ভগবান ব্রহ্মা কেবল তাঁকে নয়, তাঁর সহচর জ্বরাসুরকেও পুজো করার জন্য মানবজাতিকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
অপর একঠি কাহিনিতে দেখা যায়, দুর্গা কাত্যায়ন মুনির ছোট্ট মেয়ে হয়ে জন্ম নেন এবং তাঁর শৈশবের বন্ধুদের কলেরা, উদরাময়, হাম, গুটিবসন্ত ইত্যাদি নানান ব্যাধি থেকে রক্ষা করেন। এই কাত্যায়নীর আর এক রূপ হল শীতলা। ব্রহ্মার কন্যা এবং কার্ত্তিকেয়ের স্ত্রী হিসেবেও শীতলাকে দেখা যায়।
আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, এমনকী আরও এক শতাব্দী আগে কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাস শীতলার বন্দনা করেছেন। পুরনো রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পঞ্জাবের মতো কিছু অঞ্চলে জ্যৈষ্ঠের সপ্তম দিনটি শীতলা পুজোর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়, গুজরাতে আবার এ পুজো হয় শ্রাবণ মাসে। শীতলা মানে ঠান্ডা, তাঁর পুজোয় আগুন জ্বলে না, সব খাবার ঠান্ডা খাওয়ার রীতি।
তিন শতাব্দী আগে কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’ খ্যাত জে জেড হলওয়েল শীতলা দেবীর আরাধনা বিষয়ে লিখেছেন। দুই শতাব্দী আগে জন মুর তাঁর হিস্ট্রি অব স্মলপক্স বইতে শীতলার কথা উল্লেখ করেছেন। এক শতাব্দী আগে সি এইচ বাক লিখেছেন, শীতলা বা মাতা হলেন সাত বোনের এক গোষ্ঠীর নেত্রী, এই সাত দেবীই মহামারী ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁকে নিয়মিত তুষ্ট করা নারী ও শিশুদের দায়িত্ব। আধুনিক ওষুধপত্রের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শীতলা ও তাঁর বোনদের প্রতিপত্তি কমেছে ঠিকই, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, গোড়ায় তিনি ছিলেন এক অশুভ শক্তি। মার্কিন নৃবিজ্ঞানী র্যাল্ফ নিকোলাস গত শতকের সত্তরের দশকে মেদিনীপুরে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে স্থানীয় ধর্মাচারকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং এ বিষয়ে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য লিখেছেন।
গুটিবসন্ত নামক ভয়াবহ ব্যাধিটির দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই সম্ভবত শীতলার সৃষ্টি, এবং এই ধারণা প্রচার করা হয়েছে যে, তাঁকে ভাল করে পুজো করে সন্তুষ্ট করতে পারলে এই রোগ থেকে তিনি মানুষকে বাঁচাবেন। শিবের পরম ভক্ত রাজা বিরাট তাঁকে যথেষ্ট ভক্তি করতেন না, এই অপরাধে শীতলা তাঁর রাজ্যে নানান আধিব্যাধির এমন মহামারী লাগিয়ে দেন যে, রাজা শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করেন। তিনি শীতলার করুণা ভিক্ষা করলে দেবীর মন গলে, বিরাটরাজ্য রোগমুক্ত হয়।
একেবারে দক্ষিণ ভারতকে বাদ দিলে গোটা উপমহাদেশে শীতলা একটিই নামে পূজিত। স্থানীয় লোকবিশ্বাসের একটা অভিন্ন চরিত্র ছিল। কারও কারও ধারণা, শবররা এই দেবীর পূজা প্রবর্তন করেন, কিন্তু এর কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে শীতলার পুজো করেন, কে কী ভাবে ব্যাধির প্রকোপকে দেখেন তার ওপরেই সেটা নির্ভর করে। বাংলায় তাঁর পুজো হয় বসন্তকালে, ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি-মার্চে।
অনার্যরা দিব্যি একটা পাথরখণ্ড বা অন্য কোনও প্রতীকের, এমনকী একটা কলসির পুজো করত। বহু যুগ ধরে শীতলা পূজিত হয়েছেন একটি কালো পাথর, কিংবা বটগাছের নীচে একটি বেিদর ওপর হলুদ কাপড়ে ঢাকা প্রস্তরখণ্ড রূপে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট মানবপ্রতিম মূর্তি না হলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চলে না। অতএব ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হল, শীতলাকে কল্পনা করতে হবে রক্তাম্বরা এক দেবী রূপে, যিনি ময়ূরবাহিনী, যাঁর হাতে ধরা একটি মোরগ। অঞ্চলভেদে এই দেবীর প্রতিমায় তারতম্য ঘটে, কোথাও কোথাও একটি ছোট্ট পুতুলের পুজোও হয়। বাংলায় এবং অন্য নানা জায়গায় শীতলা আসেন গাধার পিঠে চড়ে— আর সব বাহনকে ইতিমধ্যেই অন্য দেবদেবীরা দখল করে ফেলেছিলেন বলেই বোধহয়। তাঁর হাতে একটি ছোট ঝাঁটা, যা দিয়ে রোগজীবাণু তাড়াবেন; একটি কলসি, যার ঠান্ডা জলে রোগীকে আরাম দেবেন; আর একটি পাত্র, যার মধ্যে ব্যাধিকে বন্দি করবেন; আর আছে একটি চামর, যা দিয়ে ধুলোবালি থেকে জীবাণুকে আলাদা করবেন। গোটা দেশে তাঁর একটাই নাম, এটা দেবীর সামর্থ্য এবং জনজীবনে গভীর শিকড়ের পরিচয় দেয়।