সংবিধান বদলে ‘এক দেশ এক দল’ শাসন ব্যবস্থা কায়েম করাই এখন লক্ষ্য মোদীর!
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন। অর্থাৎ একই সঙ্গে লোকসভা এবং তাবৎ রাজ্যের বিধানসভা ভোট। বহুচর্চিত এই ইস্যুকে এবার দ্রুত বাস্তবায়িত করতে চাইছে মোদী সরকার। গড়া হয়েছে কমিটি। সেই কমিটির সভাপতি কে? রামনাথ কোবিন্দ। অবসর নেওয়ার পর সাধারণত একজন রাষ্ট্রপতি যাবতীয় রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সক্রিয়তা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। এক্ষেত্রে সদ্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে এমন এক সরকারি এবং চূড়ান্ত রাজনৈতিক কমিটির মাথায় বসানো স্পষ্টতই নজিরবিহীন। তৎপরতা এমনই যুদ্ধকালীন যে, এই ইস্যুতে আইন কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট আসা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে রাজি নয় কেন্দ্র। বৃহস্পতিবারই পাঁচদিনের বিশেষ সংসদ অধিবেশনের ডাক দিয়েছে কেন্দ্র। আর তার ঠিক পরদিন ওয়ান নেশন ওয়ান ভোট কমিটির ঘোষণা। জল্পনার ভরকেন্দ্র তাই একটাই—তাহলে কি আসন্ন অধিবেশনেই এ বিষয়ে আলোচনা চায় মোদি সরকার?
লোকসভা ভোট যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে তখন কেন ‘এক দেশ এক ভোট’ (One Country One Election) ব্যবস্থা চালুর জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কেন্দ্র কমিটি গড়ল তা অনেকের কাছেই বোধগম্য হচ্ছে না। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। কমিটির পক্ষে আগামী ১৮ দিনের মধ্য রিপোর্ট জমা করা অসম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনের এই নয়া ব্যবস্থা চালুর সপক্ষে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবং আইন কমিশনের রিপোর্ট আগে থেকেই জমা হয়ে আছে। জমা আছে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টও। শুক্রবারই বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চলতি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলিকে ডেকে আলোচনা করবেন বলে জানা গিয়েছে।
সংসদে বিল পাশ করানোর পর দেশের দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২০টি বিধানসভায় সেটি অনুমোদন করাতে হবে। বিজেপি এখন ১৪টি রাজ্যে একক অথবা জোট সরকার চালাচ্ছে। তাছাড়া, নয়া ব্যবস্থা চালুর জন্য শুধু সংবিধান সংশোধন করলেই চলবে না, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং সংসদীয় ব্যবস্থাতেও অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। যদিও এই সময় সংশোধনী পাশ করানো বিজেপি সরকারের কাছে জলভাত। তবে এতকিছু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অনেকেই মনে করছেন, সরকার নিশ্চয়ই বিকল্প কিছু রাস্তা বের করে রেখেছে। যদি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই যৌথ ভোট কার্যকরের ভাবনা না থাকত তাহলে এখন তড়িঘড়ি কেন কমিটি গড়া হল আর কেনই বা এক মাসের ব্যবধানে সরকার ফের সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে।
একঝাঁক প্রশ্ন আবর্তিত হচ্ছে এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে। সামগ্রিক নির্বাচনের পর কোনও রাজ্যের সরকারের যদি হঠাৎ পতন ঘটে, তখন সেই রাজ্যে কী হবে? পাঁচ বছরের অপেক্ষা? রাষ্ট্রপতি শাসন? কবে আবার একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট হবে, সেই পর্যন্ত? অর্থাৎ আদতে কেন্দ্রের শাসন। কিন্তু যদি কেন্দ্রীয় সরকারের পতন হয়? তাহলে সব রাজ্যে আবার নির্বাচন হবে? ১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৯১, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪—এই বছরগুলিতে সময়ের আগেই ভেঙে পড়েছে কেন্দ্রের সরকার। বিধানসভার নিরিখে তো উদারহণ অসংখ্য। তাহলে এই সমস্যা কীভাবে মিটবে? প্রশ্ন কিন্তু আরও আছে। ১) এই কমিটি কবে রিপোর্ট দেবে? আসন্ন অধিবেশনের আগেই? ২) আগামী লোকসভা নির্বাচন থেকেই চালু হবে এই প্রক্রিয়া? ৩) নির্বাচিত সব বিধানসভাই কি তাহলে ভেঙে যেতে চলেছে?
একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট হয়েছে ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫৬ ধারা জারি কেরল সরকারকে ফেলে দিয়েছিল। সেই প্রথম এই ব্যবস্থার ধাক্কা খাওয়া শুরু। ১৯৬৭ সালে আটটি রাজ্যে কংগ্রেস হেরে যায়। কেন্দ্রে তাদের সরকার থাকলেও একের পর এক রাজ্যে পতন ঘটে কংগ্রেসের। একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের সমাপ্তি সেখানেই। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে একের পর এক সংশোধনী হয়েছে। কিন্তু আসল কথাটা হল, ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন সংসদীয় গণতন্ত্রে সফল হয়নি। আমেরিকার মতো প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্রে সম্ভব। নাকি চীন-রাশিয়ার মহাজ্ঞানী মহাজনরাই অনুপ্রেরণা? এই প্রশ্ন উঠছে।
প্রস্তাবিত ব্যবস্থার অনেক সমস্যাও আছে। প্রধান সমস্যা হল, ‘এক দেশ এক ভোট’ ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বিপাকে পড়বে আঞ্চলিক দলগুলি। তারা রাজ্য ভোটের জন্য যে পৃথক নির্বাচনী ইস্যু প্রকাশ করবে, তা জাতীয় ইস্যুর চাদরে ঢাকা পড়ে যাবে। প্রচারেও বিরাট ধাক্কা খাবে আঞ্চলিক দলগুলি। তুলনায় জাতীয় দলগুলি প্রচারে অনেক বেশি সুবিধা পেয়ে যাবে। তাতে রাজ্যবাসীর প্রত্যাশাও অপূরণীয় থাকবে। কারণ যৌথ ভোটে সর্বদা জাতীয় ইস্যুই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যৌথ ভোটে যে দল ৭০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছে পৃথক ভোটে সেই দলই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। অনেকেই মনে করছে, নরেন্দ্র মোদী সরকার আসলে ‘এক দেশ এক দল’ শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যেই ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে চাইছে।