কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

সত্যজিৎ থেকে তপন সিনহা, পরিচালকরা সুনীলের গল্পকে পর্দায় এনেছেন বারবার

September 7, 2023 | 3 min read

সৌভিক রাজ

চলচ্চিত্র নির্মাতারা ছবির জন্যে গপ্পো খুঁজতে বারবার উঁকি দিয়েছেন সাহিত্যের পাতায়। পাতা থেকে গপ্পো পৌঁছেছে পর্দায়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকার হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁরও একাধিক গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবি, বইয়ের পাতা থেকে রুপোলি পর্দায় উঠে এসেছে সুনীলের সৃষ্টি। বাংলার প্রবাদপ্রতিম পরিচালকেরা বারবার বেছে নিয়েছেন নীল লোহিতের সাহিত্যকে। প্রথম জীবনের সুনীল ছিলেন বোহেমিয়ান, অভাব তো সঙ্গী ছিলই। নিজেই কৃত্তিবাস পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন। কৃত্তিবাস তখনও আজকের মতো মহীরুহ হয়নি। সুনীল, জলসা পত্রিকার সম্পাদক ক্ষিতিশ বাবুর প্রেস থেকে ধারে কৃত্তিবাস ছাপালেন। কিন্তু ছাপার ঋণ শোধ হল না। একদিন ঋণের টাকার জন্য সুনীলকে রাস্তায় পাকড়াও করলেন ক্ষিতিশ বাবু। বললেন ধার আর মিটিয়ে কাজ নেই! আপনি আমার পত্রিকার জন্য ফ্রিতে একটা উপন্যাস লিখে দিন, আপনার ঋণ শোধ।

১৯৬৮ সালে কৃত্তিবাস ছাপার ঋণ মেটানোর তাগিদে শারদীয়া জলসা পত্রিকায় প্রকাশিত হল অরণ্যের দিনরাত্রি, এতে সুনীল নিজের জীবনের কাহিনীই বুনলেন। উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার দু-বছর পরে ১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায় ঐ গল্প নিয়েই ছবি করলেন। নামটাও এক রাখলেন “অরণ্যের দিনরাত্রি”। সিনেমার প্লটের দাবীতে কাহিনীর কিছুটা পরিবর্তন করলেও, উপন্যাসের দাবী চলচ্চিত্রে অক্ষুন্ন রাখলেন। উপন্যাস থেকে একটি জোরালো সিনেমাবান্ধব প্লট তৈরি করলেন সত্যজিৎ। কেবল চরিত্র বা জায়গার নাম বদল নয়, বদলে গেল গল্পের সম্পর্কের সমীকরণও। ১৯৭০ সালে কলকাতার প্রিয়া, বসুশ্রীসহ একাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত চলচ্চিত্র অরণ্যের দিনরাত্রি! মুক্তির সাথে সাথেই ছবিটিকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হল। সিনেমার খাতিরে গল্পে যে যে পরিবর্তন এনেছিলেন সত্যজিৎ, তা লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মোটেও পছন্দ হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল, সত্যজিৎ তাঁর গল্পের মেজাজটাই আমূল বদলে দিয়েছেন। পরবর্তীতে আনন্দলোক পত্রিকার সত্যজিৎ সংখ্যায় (মে, ১৯৯২) সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিচারণায় সুনীল বলেছিলেন, ‘নির্লিপ্তভাবে এ ছবি দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিজে এবং আমার কয়েকজন বন্ধু এই উপন্যাসের আসল চরিত্র।’

এত বিতর্ক সত্ত্বেও অরণ্যের দিনরাত্রি কিন্তু সত্যিই একটি ক্লাসিক ছবি। যা সময়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। এটিই সুনীলের গল্প নিয়ে তৈরি হওয়া প্রথম ছবি। সৌমিত্র-সত্যজিত-সুনীলের ত্রিগলবন্দী, তার উপর রবি ঘোষ, সমিত ভঞ্জ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়; আজও অরণ্যের দিনরাত্রি দর্শকদের বড্ড প্ৰিয়। ওই বছরই শেষের দিকে সুনীলের আরেক গপ্পো নিয়ে সত্যজিৎ বানালেন প্রতিদ্বন্দ্বী। মানিক বাবুর নির্দেশনা, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয় আর সুনীলের কলমের জোরে প্রতিদ্বন্দ্বীও কাল্ট হয়ে গেল।

অন্যদিকে সুনীল লিখছেন, আরও লিখছেন। ফেলু-ব্যোমকেশ ডমিনেটেড বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এলেন কাকাবাবু ও সন্তুকে, আনন্দমেলায় প্রকাশিত হতে থাকল তা। এই কাকাবাবুর গল্প নিয়েই ১৯৭৩ সালে তপন সিংহ, সমিত ভঞ্জকে নিয়ে বানিয়ে ফেলেন সবুজ দ্বীপের রাজা। এরপর অনেক বছর গ্যাপ, ১৯৯৫ সালে ফের কাকাবাবু ফিরলেন পর্দায়, সেই সঙ্গে পর্দায় সুনীলের কাহিনীও প্রত্যাবর্তন করল। নাম ভূমিকায় থাকলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। তৈরি হল কাকাবাবু হেরে গেলেন, এক টুকরো চাঁদ। টেলিভিশনেও কয়েকটি কাকাবাবু সিরিজের গল্প নিয়ে টেলি ছবি তৈরি হল। বড় পর্দার জন্য তাপস পালও কাকাবাবুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু সে ছবি আর মুক্তি পায়নি। এরপর অবশ্য অনেক দিন সুনীলের গল্পকে পর্দায় দেখেনি বাঙালি দর্শক। ২০১০-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস মনের মানুষ অবলম্বণে ছবি বানালেন গৌতম ঘোষ। মনের মানুষ উপন্যাসটি লালন সাঁইয়ের জীবনী নির্ভর। উপন্যাসের নামেই ছবির নাম হল, ছবিতে লালনের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ২০১৩ তে সেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ফিরল সন্তু। এবার সুনীলের কাকাবাবু অর্থাৎ রাজা রায়চৌধুরী হলেন প্রসেনজিৎ। কাকাবাবু সিরিজকে পর্দায় ফেরালেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। যদিও এইবারের কাকাবাবুকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেখে যেতে পারেননি। মিশর রহস্য, ইয়েতি অভিযানের পরে সৃজিত ইতিমধ্যেই বানিয়ে ফেলেছেন কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Satyajit Ray, #films, #Tapan Sinha, #Sunil Gangopadhyay

আরো দেখুন