দাদা এখন বাপ্পা! বাংলার গণেশ, বাঙালির গণেশ ভ্যানিশ?
সৌভিক রাজ
ফেলুদা ঘোষালবাড়ির নকল গণেশটা পারিশ্রমিক হিসেবে চেয়ে নেওয়ার সময় কি আদৌ ভেবেছিলেন তাঁর জন্মভূমিতে গণেশের এহেন দাপট হবে? বিশ্বকর্মাকে ব্যাকফুটে ঠেলে কুমারটুলি গণেশ বানাতে কালঘাম ছোটাবে!
দাদা থেকে তিনি বাবা থুরি বাপ্পায় উন্নীত হলেন, এ সফরে বাঙালি হারালো বাঙালিয়ানা। কেমন করে? মিষ্টির দোকানগুলোতে মোদক কেনার ভিড় এর উত্তর দেবে। ছানা বাঙালির পাকঘরে প্রবেশাধিকার পাওয়া পূর্বে বা দেবভোগ্য হয়ে ওঠার আগে, চিনি, গুড়, ক্ষীর ইত্যাদির মিষ্টি খেত বাঙালি। তিল, নারকেল, চাল গুঁড়ো দিয়েও তৈরি হত মিষ্টি কিন্তু কোনওদিন মোদক বঙ্গে জাঁকিয়ে বসেনি। হালের কয়েক বছরে মোদক হালে পানি পেয়েছে। গণেশকে লাড্ডু প্রেমী বলেই জেনে এসেছে বঙ্গ সন্তানরা। আজ দেখুন সে বাঙালিও মোদক কিনছে!
রাজনীতি ধর্মকে চালায়? না ধর্ম রাজনীতিকে? ভারতে এ প্রশ্ন কেমন ‘ফিডব্যাক মেকানিজম’ গোছের হয়ে গিয়েছে। রাজনীতি আম আদমির আর্থ-সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, উৎসব সেই জীবনেরই এক অঙ্গ। সেই কারণে, গত এক দশকে বাংলায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাপ্পার পুজো বেড়েছে, পত্নী বিরহে কাতর শ্রীরাম পাঁচালির রাম ছেড়ে বলশালী রামে মজেছে বাঙালি, বেড়েছে বজরং বলির আরাধনা, ভুঁড়ি-গোঁফওয়ালা শিবের বদলে ‘মাসেলম্যান’ শিবের আবির্ভাব হয়েছে। সব দেবতার কেমন গো-বলয়ীয় রূপান্তর ঘটেছে, বাদ পড়েননি বিশ্বকর্মাও। মা-কে ‘মাতা দি’ বলার অভ্যাসের আরও একটি কারণ রয়েছে, তা হল বহিঃর্বঙ্গের সংস্কৃতির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। যেমন ধরুন সন্তোষী মা, তিনি বাঙালির ঠাকুর হলেন সিনেমা রিলিজের পর। ঠিক যেমন গণেশ নিয়ে বলিউড এত সিনেমা বানালো আর গণেশকে এমনভাবে উপস্থাপন করল যে, গণেশ মিশে যেতে লাগলেন আবহমান সংস্কৃতির ধারার। তিনি আর নতুন সংযোজন হিসেবে আটকে থাকলেন না। হুজুকে বাঙালি একটু বেশিই আপন করে নিল। আজ চারদিকে যে’সব গান বাজছে শুনে মনে হচ্ছে আমি খাঁটি হিন্দিভাষী কোনও রাজ্যে আছি, নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে।
বাংলায় এমন কোনও পুজো হয় না যেখানে গণেশের আরাধনা হয় না। মন্ত্রোচ্চারণের শুরুতে গণেশ বন্দনা করে নেন পুরোহিত, এটাই রীতি। এমনই হয়ে আসছে। সিদ্ধি-সমৃদ্ধির দেবতাকে বছরে দু’বার পুজো করে বাংলা। পুণ্যাহের সময় অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে এবং কেউ কেউ অক্ষয় তৃতীয়ায় লক্ষ্মীর সঙ্গেই পূজিত হন তিনি। দীপান্বিতা কালী পুজোর দিন লক্ষ্মী পুজো করেন অনেকেই, কিছু কিছু বাড়িতে ওইদিন লক্ষ্মীর সঙ্গে গণেশও পুজো পান। ছাড়াও দেবী দুগ্গার সঙ্গে তিনি আসেন। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, দুর্গার সব সন্তানরা যখন পরিবারের সঙ্গে ছাড়াও একবার করে আলাদা আসেন তখন গণেশ কেন একা আসেন না?
এ’কথা ঠিক গণেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে কখনও লক্ষ্মীর সঙ্গে কখনও সপরিবারে পূজিত হন কিন্তু তিনি একাও আসেন। হ্যাঁ, এই বাংলাতেই আসেন। বহু বনেদি বাড়িতে মাঘ মাসে পূজিত হন গণেশ, আর এককভাবেই হন। ভবানীপুরের মল্লিক বাড়িতে মাঘ মাসের শুক্ল চতুর্থীতে অর্থাৎ শ্রীপঞ্চমীর আগের দিন গণেশ পুজো হয়। ভাদ্রর শুক্ল চতুর্থী ছাড়াও মাঘের শুক্ল চতুর্থীকেও তার আবির্ভাব দিবস মনে করা হয়।
বাঙালির গণেশ ঠিক কেমন?
“গনেশ দাদা পেটটি নাদা
গায়ে মেখেছো সিঁদুর।
কলাগাছকে বিয়ে করেছ
বাহন তোমার ইঁদুর!”
বাঙালির গণেশ নধরকান্তি, ভুঁড়িওয়ালা সুখী শরীর তাঁর। তাঁর গাত্র বর্ণ লাল। তিনি উপবীত ধারী। অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলা-য় রয়েছে, “পেটটি বিলিতি-বেগুনের মতো রাঙা চিকিচিকে, মাথাটি শাদা, শুঁড়টি ছোট-একটা কেঁচোর মতো পেটের উপর গুটিয়ে রয়েছে; কানদুটি যেন ছোট দুখানি কুলো, তাতে সোনার মাকড়ি দুলছে; গলায় একগাছি রূপোর তারের পৈতে ঝোলানো; পরনে লাল-পেড়ে পাঁচ-আঙুল একটি হলদে ধুতি, গলায় তার চেয়ে ছোট একখানি কোঁচানো চাদর; মোটা-সোটা এতটুকু দুটি পায়ে আংটির মতো ছোট-ছোট ঘুঙুর, গোল-গাল চারটি হাতে বালা, বাজু, তাড়; গলা থেকে লাল সুতোয় বাঁধা ছিটমোড়া ছোট্টো ঢোলকটি ঝুলছে।”
তবে গণেশ শিশু রূপেও পূজিত হন বঙ্গে, গণেশ জননী-র সঙ্গে। অবন ঠাকুর থেকে যামিনী রায়, সকলের ক্যানভাসেই ধরা দিয়েছে দেবীর গণেশ জননী রূপ। মায়ের কোল আলো করে বসে আছেন ছোট্ট গণেশ। মাঘী পূর্ণিমার পর শান্তিপুরে গণেশ জননীর আরাধনা হয়, স্বামী মহেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে গণেশ জননী শান্তিপুরে আসেন। গণেশ জননী পুজোর সূত্রপাত শান্তিপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পরিচালিত অন্নপূর্ণা পুজোকে কেন্দ্র করে। সাহা পরিবারের সদস্যরা অন্নপূর্ণা পুজোর দায়িত্বভার সুবর্ণ বণিক এবং কংস বণিকদের হাতে তুলে দেন। তাঁরা পুজো করতে থাকেন। শোনা যায়, দেড়শো বছর আগে অন্নপূর্ণা পুজো উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এক যাত্রা পালাকে কেন্দ্র করে সুবর্ণ বণিক ও কংস বণিকের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। তখন কংস বণিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা গণেশ জননীর পুজোর প্রচলন করেন। কথিত রয়েছে, কংস বণিক সম্প্রদায়ের নিমু দত্ত, ইন্দু দত্ত, মুরারী দত্তদের নেতৃত্বে পুজোর সূত্রপাত ঘটে।
প্রসঙ্গত, মা অন্নপূর্ণার সঙ্গে গণেশ জননী বিগ্রহের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। এখানেও দেবীর ডানপাশে মহাদেব এবং বামপাশে নারদের অবস্থান। মায়ের কোলে গণেশ বসে থাকেন। মোট পাঁচ দিন ধরে চলে মায়ের আরাধনা। পুজোর শেষ লগ্নে গণেশ জননীর কোলের গণেশকে কোলে নেবার রীতি রয়েছে। যাঁরা নিঃসন্তান দম্পতি রয়েছেন, তাঁরা সন্তান লাভের জন্য পুজোর শেষে গণেশকে নিজের কোলে তুলে নেন। নবদুর্গার একটি রূপ আবার গণেশ জননী যদিও পশ্চিম ভারতে তিনি স্কন্দমাতা, এটি আদপে মা-পুত্রের যৌথ আরাধনা। স্কন্দ হলেন কার্তিকেয়। আবার দক্ষিণ বঙ্গের লৌকিক দেবতা বারা ঠাকুরের সঙ্গেও মিশে গিয়েছে গণেশ।
বাংলার মৃৎশিল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গণেশ জননী পুতুল। মজিলপুর হোক বা কৃষ্ণনগর সব জায়গায় গণেশ জননী মাটির পুতুল তৈরি হয়। মজিলপুরের গণেশ জননী পুতুলে গণেশ রঙ লাল। তিনি সুস্থ-সবল শিশু, ছোট থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এহেন গণেশকে পরাক্রমশালী দেবতা বানাচ্ছে আজকের বাঙালি। নেপথ্যে রাজনৈতিক আগ্রাসন ও আস্ফালন এবং পর সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল হওয়ার মত্ত নেশা। এখন আর গণেশকে মজা করে দাদা বলা যাবে না, অধুনা তিনি খুব সিরিয়াস দেবতা।