সুচিত্রা মিত্র – রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল যাঁর অন্তরের উৎস
রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যে চার কিংবদন্তী শিল্পী সারা বিশ্বে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুচিত্রা মিত্র। নিজের গানের গায়নে একধরনের রূপের সম্পূর্ণতার আকাঙ্খা করতেন বিশ্বকবি। সেই আকাঙ্খার চরিতার্থতা পেয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার বলেছিলেন,‘‘সুচিত্রার কণ্ঠে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে’ শুনে আমি একলা চলার প্রেরণা পাই।’’ রবীন্দ্রনাথের গান কণ্ঠে তুলে সুচিত্রা মিত্র এমন অনেককেই প্রেরণা জুগিয়েছেন। যে কারণে ‘সুচিত্রা মিত্র’ শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের গান অনেকেই গেয়ে থাকেন, কিন্তু এমনভাবে একাত্ম হয়ে তা নিজের জীবনেও অনুসরণ করতে পারেন ক’জন?
সুচিত্রা মিত্রের বড়বোনের বান্ধবী উমা স্নেহানবীশ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে কবিগুরুর স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে। কবি তখন সদ্য প্রয়াত। সেখানে গান গাওয়ার আনুষঙ্গিক কোনো বদ্যযন্ত্র ছিল না। তার মাঝেই ছোট্ট সুচিত্রা সেদিন খালি গলায় গেয়ে উঠলেন, ‘যখন পড়বে না মোর পয়ের চিহ্ন এই বাটে’। গানটি সবার খুব মনে ধরেছিল। তারপর সুচিত্রা বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে ভর্তি হলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন পর।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগেই সংগীতভবনে ছাত্রসংখ্যা কমে গিয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদার গুরুদেবকে বলেছিলেন, একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। গুরুদেব সম্মতি দিয়ে শৈলজারঞ্জন এবং তাঁর পরিচিতদের গুণীর সন্ধান করতে বলেছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একদিন বিজয়া দাস জানান, তাদের স্কুলের ক্লাস টেনের একটি মেয়ে খুব ভালো গায়। এই মেয়েটিই সুচিত্রা মিত্র। সুচিত্রার বৃত্তি মঞ্জুর হয়ে গেলে বাবার আপত্তি সত্বেও দিদিদের উৎসাহে তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন গান শিখতে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বোলপুর তখন কিছুটা শূন্য মনে হলেও সংগীতভবন মোটেও তারকাশূন্য নয়। ছাত্রদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুন্ধুতী গুহঠাকুরতা, কমলা সেন (বসু), চিত্রা মজুমদার, অশোকতরু এরা সব ছাত্র। আর শিক্ষকদের নামও কম ভারী নয়, শৈলজারঞ্জন তো ছিলেনই মাথা হয়ে, আরও ছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভিভি ওয়াঝেলওয়ার প্রমুখ।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে বলেন, ‘কী রকম ঝরঝরে চেহারা, টরটরে কথাবার্তা, কী স্মার্ট চলাফেরা! আমরা অবাক হয়ে সুচিত্রাকে দেখতুম। তখন সুচিত্রার সাথে কিছুটা সমান তালে পাল্লা দিতে চেষ্টা করত অরুন্ধুতী। কিন্তু ঠোক্করও খেতেন।’
ইন্দিরা দেবীর প্রিয় ছাত্রী ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। যদিও সুস্থির আশ্রমকন্যা তিনি কখনও ছিলেন না। কলাভবনের ছাত্রদের সাথে ভলিবল খেলেছেন। আবার কেন্দুলিতে জয়দেবের মেলায় যাওয়ার সময় সারাটা পথ সুচিত্রা ছেলেদের সাথে পায়ে হেঁটে গেছেন, অন্য মেয়েদের সাথে গরুর গাড়িতে যাননি। কোনও কিছুতে সুবিধা প্রত্যাশা করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। স্বাধীনচেতা ছিলেন। এই মানসিকতাই পরবর্তী জীবনে তাঁকে অনেক সাহায্য করেছে।
সঙ্গীতভবন থেকে বের হওয়ার বছরই তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। রেকর্ডের একপিঠে ছিল ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।’ অন্য পিঠে ‘হৃদয়ের একূল ওকূল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেইকালেও প্রথম রেকর্ডে অপরিমেয় সাফল্যলাভ করেন তিনি। ফলশ্রুতিতে তাঁর ৪৭-এ দুটি, ৪৮-এ তিনটি, ৪৯-এ তিনটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে এমন গানও আছে, যার সাথে সুচিত্রার নাম চিরদিন জড়িয়ে থাকবে। যেমন ‘সার্থক জনম আমার’, ‘নৃত্যের তালে তালে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে’, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে’ ইত্যাদি।
সুচিত্রা মিত্র সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। ধ্রুব মিত্র সুভদ্র হলেও দায়িত্ববোধের অভাব ছিল। ফলে, সংসারের খরচ অনেকটাই সুচিত্রাকে যোগাড় করতে হতো। ধ্রুব আবার তার স্বাধীনচেতা স্বভাবও মেনে নিতে পারেননি। ফলে একসময় আলাদা হয়ে বাস করতে শুরু করলেন তিনি। সেকালে একজন মহিলার একা থাকা সমাজে যথেষ্ট কৌতূহলের জন্ম দিত। ফলে তাঁর নামে নানারকম গুজব ছড়িয়েছে কিন্তু তিনি এসবে কান দেননি।
গণনাট্য’র হয়ে অনেক গান করেছেন সুচিত্রা মিত্র। ১৯৫১ সালে পূর্ব বার্লিনে গিয়েছেন গান গাইতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাসের সাথে তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। ১৯৭১-এ তাঁর কণ্ঠে গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। এ সময় তিনিও আমাদের শিল্পীদের সঙ্গে পথে পথে গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে চলচ্চিত্রের বহু গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এই শিল্পী। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। এমনকি অভিনয়ও করেছেন ঋতুপর্ণা ঘোষ পরিচালিত ‘দহন’ চলচ্চিত্রে।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকারের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি ‘পদ্মশ্রী’ এবং বিশ্বভারতীর ‘দেশকোত্তম’ পুরস্কারে ভূষিত হন সুচিত্রা মিত্র। পেয়েছেন এইচএমভি’র গোল্ডেন ডিস্ক এওয়ার্ড। ১৯৪৬ সালে দ্বিজেন চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন রবিতীর্থ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘকাল। রবিতীর্থ পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি বইও আছে।
তিনি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত জনপ্রিয় করেননি, মানুষ যাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে এমন একটা আবহ তৈরি করেছিলেন। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। শব্দের সঙ্গে ভাবের মুগ্ধ সমন্বয় ছিল তাঁর কণ্ঠে। বিশেষ করে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘আনন্দলোক মঙ্গলালোকে’, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানগুলি তাঁর গলায় বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়। রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল তাঁর অন্তরের উৎস।