আজ চাপড়া ষষ্ঠী, জেনে নিন এই ব্রতর নেপথ্যে প্রচলিত কাহিনি

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ‘চাপড় যায় ভেসে / ছেলে বাঁচুক হেসে’
আজ চাপড়া ষষ্ঠী। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় এই ব্রত। সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই পুজো করা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস পুত্রবতী মহিলারা এই ব্রত করলে তাদের আর সন্তানশোক হয় না।
জেনে নিন এই ব্রতের নেপথ্যে প্রচলিত কাহিনি
কোনও এক দেশে দেশে এক সওদাগর তার গিন্নী, তিন ছেলে-বউ এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে বাস করতেন। তাদের স্বচ্ছল অবস্থা ছিল। তাদের ৩ বউয়ের ৩ ছেলে। তার মধ্যে ছোট বউএর ছেলেকে সবাই একটু বেশি ভালোবাসত। একসময় ভাদ্রমাসে ষষ্ঠী পুজো আসবার সময় গিন্নী সওদাগরকে বলল “ছেলেপুলে নিয়ে অন্যদের পুকুরে ষষ্ঠী পুজো দিতে যেতে ভালো লাগে না। যদি নিজেদের পুকুর থাকত, কত ভাল হত। “
এই কথা শুনে সওদাগর তাঁর বাড়ির সম্মুখে বড় পুকুর কাটালো ও তার চারিদিকের ঘাট বাঁধিয়ে নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়ে দিল। কিন্তু পুকুরে এক ফোঁটা জল উঠল না। তাই দেখে সওদাগর ও তার পরিবার খুব কষ্ট পেল। পাড়ার লোকেরা বলতে লাগল , “নিশ্চয়ই ওরা পাপী লোক, তাই ওদের পুকুরে জল উঠছে না।” এসব কথা শুনে সওদাগর মনে মনে মা ষষ্ঠীকে ডাকতে থাকলেন।
মাঝরাতে স্বপ্ন দেখল যে, একজন সধবা স্ত্রীলোক এসে বলছে, “তোরা ওঠ, আমি ষষ্ঠী ঠাকুর! তোদের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে যদি ছোট বউয়ের ছোট ছেলেকে কেটে আমার নাম করে শুকনো পুকুরে তাঁর রক্ত ছড়িয়ে দিস্, তাহলেই দেখবি পুকুরের জল থৈ থৈ করছে। এটা না করলে কোনও সুবিধা মিলবে না “।
ঘুম ভেঙে সওদাগর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। গিন্নীকে সব কথা জানাল। সকালে নিজের কাজ সেরে ছোট নাতিকে কাছে নিয়ে এল। তাকে খুব আদর করে, নিজের মনকে শক্ত করে ভাবল মা ষষ্ঠীর আদেশ পালন করতেই হবে। মা’র দয়া হলে আবার মা নাতিকে ফিরিয়ে দেবেন এই আশায় তিনি তাঁর ছোট নাতিকে কেটে তার রক্ত পুকুরে দিয়ে দিল। যেই না দেওয়া, অমনি পুকুরের চারদিক জলে ভরে গেল। সওদাগর তাড়াতাড়ি গিন্নীকে ডেকে আনল। তারপর পুরোহিত ডেকে পুকুর প্রতিষ্ঠা করল। সেইদিনই ছিল ষষ্ঠী। তারা সবাই মিলে ঘাটে ষষ্ঠী পুজো করতে বসল। পুজোর শেষে ব্রত কথা শুনে সবাই তার ছেলের নাম করে পিটুলির পুতুল ও চাপড়া জলে ভাসাল , “চাপড়া গেল ভেসে।,(ছেলের নাম করে) অমুক এল হেসে।”

অমনি ছোট বউ এর ছেলে তার আঁচলে টান দিয়ে জলের ভিতর থেকে উঠে এল। তা দেখে ছোট বউ তার ছেলের গা পুছিয়ে কোলে বসিয়ে খুব আদর করল, কিন্তু কিভাবে সে জলের ভেতর থেকে উঠে এল জিজ্ঞেস করতেও ছেলে কিছু বলল না। এরপর সওদাগর তাঁর স্বপ্নের কথা সবাইকে জানালে ছোট বউ ভয়ে মূর্ছা গেল। পরে চেতনা ফিরলে সে মা ষষ্ঠীকে প্রনাম করে খুব কাঁদল। তারপর তিন বউ মিলে মা ষষ্ঠীর খুব নাম জপ করল।
সঙ্গে সঙ্গে ছোট বৌয়ের সব খবর বণিকের কাছে গেল। বণিক তখন পুকুর ঘাটে এসে ঘুমের সময় স্বপ্নে মা ষষ্ঠীর আদেশের কথা সবাইকে জানাল। শুনে সকলে খুব আশ্চর্যান্বিত হলো। এর পর বণিকের সব ছেলে বউয়েরা তাঁদের ছেলেদের কোলে নিয়ে আঁচলে কলা বেঁধে ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্যের কথা শুনতে বসল। ধীরে ধীরে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে বণিক অনেক ধনসম্পত্তি পেল। আর বণিকের বউ চারিদিকে মা ষষ্ঠীর মহিমা প্রচার শুরু করে দিল জনগণের মধ্যে।

এই মন্থন ষষ্ঠী বা চাপড়া ষষ্ঠী আসলে চর্পট ষষ্ঠী নামেও পরিচিত।
চৰ্পট পুং[ √চুপ, দীপ্তি + অট্ ( অটন্ )-ক]
১ চপেট, চাপড়।
২ বিস্তার, বিপুলতা।
৩ পর্পট, পাপর।
চর্পটা — (স্ত্রী) ভাদ্র শুক্লপক্ষীয়া ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী।
চর্পটী — (স্ত্রী) পিষ্টকবিশেষ।
‘চাপ’ বা ‘চাপড়’ বা ‘চাপড়া’ অর্থে করতলসদৃশ চওড়া মৃত্তিকাখণ্ড বোঝায়। চণ্ডীদাস লিখেছেন, “মাটি খোদাইয়া, খাল বানাইয়া. উপরে দেওল চাপ”। আবার শিবায়ন কাব্যে পাই, “ছোট হালুয়া হুঙ্কারে চোটায়ে তোলে চাপ”।
চাপড়া ষষ্ঠীতে উপকরণ হিসেবে দরকার হয় কাঁঠালী কলা, পিটুলি, খোল বা এঁটে। ভাদ্র মাসের ষষ্ঠীর দিন পিটুলির পুতুল তৈরি করে এবং চাপড়া তৈরি করে পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হয়। কোথাও কোথাও কলা গাছের বাকল আর নারকেল পাতার খিলি দিয়ে বিশেষ ধরনের নৌকা তৈরি করা হয়। সেই নৌকায় রাখা হয় পিটুলি দিয়ে তৈরি পুতুল এবং রিংয়ের মতো দেখতে পিটুলির চাপড়া। সেটিতে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। পুজো শেষ হলে সেই নৌকাটি জলে ভাসিয়ে দেয় ব্রতীনীরা। মূলত ছেলেদের মায়েরা এই লৌকিক উৎসবে যোগদান করেন। তাঁরা আঁচলে কলা বেঁধে ছেলেমেয়েকে কোলে নিয়ে চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতকথা শোনেন। এদিন ভাত খাওয়া যায় না। তার বদলে লুচি, পরোটা খাওয়ার বিধান রয়েছে।
তথ্যঋণ:
মেয়েদের ব্রতকথা- লেখক, আশুতোষ মজুমদার, পৃষ্ঠা ৩৬
মেয়েদের ব্রতকথা- লেখক, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ৮৮