রাজ্য বিভাগে ফিরে যান

জিতার ডালায় বোধন আসে-‘জিতাষ্টমী’, আজ থেকে শুরু ‘দুগ্গাপুজো’

October 6, 2023 | 4 min read


বাংলার মতো এত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপূর্ণ লৌকিক ইতিহাস আর কোথাও দেখা যায় না। বঙ্গের দক্ষিণাংশে ও রাঢ় বাংলায় আজ জিতা পরব। প্রচলিত কথায় জিতাষ্টমী। কথায় বলে জিতার ডালায় বোধন আসে, অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর পরের দিন কৃষ্ণনবমীতে কোথাও কোথাও দেবীর বোধন হয়। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মায়ের আগমনের অপেক্ষাকে আরও বাড়িয়ে তোলে ‘জিতাষ্টমী’। দুর্গাপুজোর আগে আশ্বিনে যে অষ্টমী আসে, সেই অষ্টমীর পালনের মধ্য দিয়ে মায়ের বোধনের সূচনা হয়। অনেকে আবার এই তিথিকে ‘কৃষ্ণা অষ্টমী’ও বলে থাকেন। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রামজুড়ে জিতাষ্টমী পালিত হন। এ এক অনন্য দুর্গোৎসবের সূচনা। মূলত বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার আঞ্চলিক মানুষদের মধ্যে বেঁচে থাকা প্রাচীন প্রথা ‘জিতাষ্টমী’। এই রীতির মাধ্যমে আগমন ও বোধনকে সংহতি জানান হয়।


তার আগে এই ব্রত প্রচলনের গোড়ার কথা জানতে হয়, ত্রেতাযুগে চম্পকনগরে এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিল, তার কন্যার নাম ছিল সুন্দ্রা মতান্তরে সুভদ্রা। একবার রাজ্যে খরা দেখা দিল। রাজা ঘোষণা করলেন, তার বাবার শ্রাদ্ধের জন্য যে আতপ চাল তৈরি করে দেবে, তাকে তিনি একটি সোনার তাল পুরস্কার দেবেন। রাজ্যে বৃষ্টির দেখা নেই, কেউ সাহস করে এগিয়ে এল না। সেই ব্রাহ্মণ কন্যা সুন্দ্রা এগিয়ে এল। সে উপবাসী থেকে ভক্তিসহকারে সূর্যের আরাধনা করতে লাগলো। সূর্যদেব তার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিলেন আর তার ঘরে কিরণ দান করলেন। চাল তৈরি হল। সুন্দ্রা রাজাকে চাল দিয়ে পুরস্কার পেল।

অন্যদিকে, ঘটল আরেক ঘটনা। সুন্দ্রার রূপে মুগ্ধ সূর্যদেব তার দেহে তেজ দান করলেন। সুভদ্রার গর্ভে সন্তান এল। দশ মাস দশ দিন পরে চার হাত, তামার মতো গায়ের রং, মাথায় জটা আর কানে জ্যোতির্ময় কুণ্ডল নিয়ে এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। সেই হল জীমূতবাহন। ছেলেটি বড় হয়েই তার বাবাকে দেখার জন্য বায়না ধরল। সূর্যদেব যে পথে উদয়গিরি যান, সুন্দ্রা ছেলের হাত ধরে সেই পথে গিয়ে দাঁড়াল। সূর্যের রথ আসতেই মা ও ছেলে রথ টেনে ধরল। সূর্যদেব ধ্যানযোগে সব জেনে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।


সূর্যদেব জীমূতবাহনকে আশীর্বাদ করলেন, জগতের সকলে আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে বটমূলে, প্রাঙ্গণে বা দেব মন্দিরে মেয়েরা জীমূতবাহনের পুজো করবে। যে নারী আগের দিন হবিষ্যান্ন গ্রহণ করে ব্রতের দিন উপবাসী থেকে পুজো করবে তার সন্তান অকালে মরবে না। সুন্দ্রাকেও আশীর্বাদ করলেন, পুত্রের সঙ্গে তারও পুজো হবে। ফিরে যেতে বলে সূর্যদেব চলে গেলেন। এইভাবেই জীমূতবাহনের পুজো শুরু হল।


একদা এক বটগাছের নীচে ইন্দ্রের মা অদিতি জীমূতবাহনের পুজো করছেন, সেই গাছে বসবাস করা শকুনিও দেখাদেখি পূজা করল। তাই দেখে এক শিয়ালী বলে বসল, সই। তুমি কি করছ? শকুনি বললে, জীমূতবাহনের পুজো করছি। এই ব্রত করলে ছেলেমেয়ে দীর্ঘজীবী হয়। ব্রতের দিন উপোস থাকতে হয়। শিয়ালী সব শুনে উপবাসী রইল, সারাদিন কাটার পর সে আর থাকতে না পেরে প্রথম প্রহরে মাছ খেয়ে ফেললে। দ্বিতীয় প্রহরে কতকগুলো পোকা-মাকড় খেয়ে ফেলল। তৃতীয় প্রহরে সে যখন মরার মাংস খাচ্ছে, তাই দেখে শকুনি রেগে বললে-পাপিনী! খিদে সহ্য করতে পারবি না যদি ব্ৰত কেন? নিয়েছিলি? এর শাস্তি পাবি।এরপর শিয়ালীর এক বছরের মধ্যে যতগুলি সন্তান হল, সব মরে গেল। শকুনির সব সন্তান বেঁচে রইল। শকুনি শিয়লীকে বলল, জীমূতবাহনের অপমান করার ফলে তোমার এই অবস্থা। শিয়ালী ক্রোধে শকুনিকে মারতে যেতেই একটি গরম ক্ষারসিদ্ধ জলের কড়াইতে পড়ে গিয়ে শিয়ালী আর শকুনি দুইজনেই মরে গেল। ধোপা নদীতে ভাসিয়ে দিল।

দৈব ঘটনায় সেই ক্ষারসিদ্ধ জলে দুটি পদ্মফুল জন্মাল। একটি নীল আর একটি শ্বেত পদ্ম। ফুল দুটি ভাসতে ভাসতে কর্নাটক রাজ্যে এল। সেই সময় কর্নাটের রানী প্রভাবতী ও পাত্র পত্নী কুমুদ্বতী নদীতে স্নান করছিল। তারা দুটি ফুল ধরে খেয়ে ফেলল, তারা গর্ভবতী হল। যথাসময়ে তাদের দুই জনের দুটি মেয়ে হল। রানীর মেয়ের নাম চম্পাবতী আর পাত্র পরীর মেয়ের নাম মনোরমা। বড় হয়ে তাদের দুই জনের খুব ভাব হল। শিয়ালী হল চম্পাবতী আর শকুনি মনোরমা হয়ে জন্মাল। একসময় কনকগড়ের রাজার সঙ্গে চম্পাবতীর আর পাত্রের ছেলের সঙ্গে মনোরমার বিয়ে হল। কিছুদিনের মধ্যে দুই জনেরই দুটি ছেলে হল, কিন্তু চম্পাবতীর ছেলেটি হঠাৎ মারা গেল।এইরকম আরও কয়েকবার তার সন্তানের মৃত্যু হল। চম্পাবতীর খুব হিংসা হল। চুপি চুপি সে মনোরমার ছেলেদের নাক কেটে কামরাঙা বলে মনোরমার কাছে পাঠিয়ে দিল। মনোরমা তখন জীমূতবাহনের পুজো করছিল। সে কামরাঙা ভেবে জীবমূতবাহকে নিবেদন করতেই তার ছেলেদের নাক আবার আগের মতো হয়ে গেল। তারপর চম্পা মনোরমার ছেলেদের এক একটি করে অঙ্গ কেটে পাঠাতে লাগল। কিন্তু জীমূতবাহনের কৃপায় সব কাটা অঙ্গই জোড়া লেগে গেল। চম্পাবতী বার বার চেষ্টা করেও মনোরমার ক্ষতি করতে পারল না। অবশেষে নিজে আত্মহত্যা করতে গেল।


শিব-পার্বতী গোটা বিষয়টা দেখছিলেন, পার্বতী বললেন প্রভু আত্মহত্যা মহাপাপ, চম্পাবতীকে বাঁচিয়ে দাও। পার্বতীর অনুরোধে মহাদেব ছদ্মবেশে চম্পাবতীর কাছে এসে বললেন, বাছা তুমি আত্মহত্যা করো না। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে উপবাসী থেকে জিতাষ্টমী ব্রত করো, তোমার ছেলে দীর্ঘজীবী হবে। শুনে চম্পাবতী ঘরে ফিরে এলো আর হিংসা ভুলে খুব ভক্তিসহকারে জিতাষ্টমী ব্রত করল। ব্রত্যের কল্যাণে তার অনেকগুলো ছেলে হল, সবাই দীর্ঘজীবি হল। তারপর সমস্ত সুখভোগ করে স্বর্গলাভ করল চম্পাবতী।


সেই থেকেই এই ব্রতর প্রচলন হল, ব্রতে বলা হয় ‘যে নারী আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে ভক্তিসহকারে জিতাষ্টমী ব্রত করে, তার সন্তান দীর্ঘজীবন লাভ করে।’


জিতাষ্টমীর তিথিকে কেন্দ্র করে মূলত তিথির দু-দিন আগে থেকে অনুষ্ঠান চলে। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির মা-মেয়ে-বৌ-বোনেরা স্নান সেরে, শুদ্ধ কাপড়ে একটি শালপাতার ডালায় আতপ চাল, সিঁদুর, কলা, শসা, বেলপাতা ও একটি টিনের ছাতনায় ভিজে ছোলাকে শ্রদ্ধাভরে ঘরের পবিত্র জায়গায় রেখে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ করেন। পরদিন সকালে ব্রতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বাড়ির প্রত্যেক মহিলা নির্জলা উপোস থেকে, আগের সন্ধ্যায় তৈরি রাখা প্রসাদী থালাকে গ্রামের কোনও এক স্থানে পুজো পাঠের জন্য রেখে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। জীমূতবাহনের উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করা হয়। রাতে জিমূতবাহনের পুজো করে বাড়ি ফিরে আসেন প্রসাদ নিয়ে। তারপর বাড়ির বাচ্চা-বৃদ্ধ ও পুরুষদের মঙ্গল আসনে বসিয়ে কার্যত বরণ করেন। পাশাপাশি হাতে শালপাতার থালায় প্রসাদ তুলে দিয়ে পরিবারের মঙ্গলকামনা করেন মহিলারা।


তারপরের দিন সেই বাড়ির মহিলারা আবারও নির্জলা উপোস থেকে, দিনের শেষে একটা সময়ে সকলে মিলে স্নান সেরে নিজেদের উপোস ভঙ্গ করতে ঘাটে যান। সঙ্গে যান পুরুষরাও। মহিলারা পুকুর বা নদীর জলে নেমে প্রত্যেকে একটা শসার আড়াই কামড় খেয়ে কার্যত ফলাহারের মধ্যে দিয়ে উপোস ভঙ্গ করেন। তারপর স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্র ধারণ করে নিজ-নিজ স্বামী-সন্তান সকলকে একসঙ্গে নিয়ে চিড়ে-মুড়ি-খই খান। খাওয়া-দাওয়ার পর সেই মহিলারা আবার নদীতে স্নানে যান করেন। ভেজা বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় প্রত্যেকে মঙ্গলঘটে নদী থেকে জল সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাড়িতে বা পুজোর মণ্ডপে সেই ঘট প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার বোধনের সূচনা হয়, এমনটাই স্থানীয় বিশ্বাস। যুগ, যুগ ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মানুষ এই প্রথা বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানেই অনন্য বাংলা।
ছবি: সমাজ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#jita astami

আরো দেখুন