‘লৌহ কপাট’ বিতর্ক নিয়ে অবশেষে বিবৃতি দিল ‘টিম পিপ্পা’, কী বলা হয়েছে সেখানে?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় পত্রিকা ‘বাঙ্গালার কথা’। মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে একের পর এক ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামীরা তখন কারারুদ্ধ হচ্ছেন। চিত্তরঞ্জন দাশও কারাবন্দী হলেন। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী দ্বারস্থ হলেন ২২ বছর বয়সী কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়েই নজরুল লিখলেন কালজয়ী এক লেখা—‘ভাঙার গান’—‘কারার ঐ লৌহকপাট’। গানটি সেই সময় তোলপাড় তুলেছিল। সম্প্রতি এই ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ নতুন করে ঝড় তুলেছে এ আর রহমান গানটিতে নতুন সুর দেওয়ার কারণে।
‘পিপ্পা’ সিনেমায় তাঁর ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ভার্সন নিয়ে নিন্দার ঝড় সর্বত্র। গত বৃহস্পতিবার সেই ছবি রিলিজের পর থেকেই রহমানকে নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। বাংলার সঙ্গীতদুনিয়া ক্ষোভে ফেটে পড়লেও নজরুল ইসলামের মতো কিংবদন্তী গায়কের সুর বিকৃতি নিয়ে কিন্তু মুখে কুলুপ জাতীয় স্তরের বিনোদুনিয়ায়। যার একটা গানকে ঘিরে এত বিতর্ক, এত নিন্দা, সেই রহমান কেন এখনও ‘নির্বাক’? প্রশ্ন তুলেছিলেন শিল্পীমহলের একাংশ।
শুধু তাই নয়, কবি নজরুল ইসলামের পরিবারও অভিযোগ করেছে, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি। সম্ভব হলে গানটিতে তারা ওই সিনেমা থেকে বাদ দিয়ে দেয়ারও দাবি করেছেন। প্রসঙ্গত, গানটির কথায় ‘কপাট’ শব্দটি বহুল প্রচলিত হলেও ১৯৪৯ সালে যে প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল, সেখানে শব্দটি ছিল ‘কবাট’। এক নজরুল গবেষক অবশ্য বলছেন কবি ঠিক কী লিখেছিলেন, তা জানার উপায় নেই, কারণ তার হাতে লেখা কবিতাটি সংরক্ষণ করা নেই।
যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন এআর রহমান।
আজ সোমবার ‘টিম পিপ্পা’র তরফে একটি বিবৃতি জারি করে বলা হয়েছে, কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের দুই সদস্য সদ্য প্রয়াত কল্যাণী কাজী ও তাঁর পুত্র অনির্বাণ কাজীর সম্মতিতেই ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল তারা। ‘টিম পিপ্পা’র তরফে বলা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীত, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে যারা ছিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। ছবিটির চিত্রায়ণের জন্য প্রয়োজনীয়তার কারণে ‘শৈল্পিপ’ কিছু রদবদল করতে তারা বধ্য হয়েছে।
যদিও কবির নাতি ও চিত্রশিল্পী কাজী অনির্বাণ দাবি করেছেন, পরিবার নির্মাতাদের গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল কিন্তু সুর ও ছন্দ বদলানোর অনুমতি দেয়নি।
অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান বাংলা গান নিয়ে তিনি আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন করেছিলেন তিনি আগে। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটিও নিজের মতো করে সুরারোপ করেছেন। নজরুলসংগীত নিয়ে এবারই তাঁর প্রথম কাজ করা। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর মূল সুরের ছিটেফোঁটাও রাখেননি তাঁর সংস্করণে। একতারা আর বাঁশির সুরে গ্রামীণ বাংলার আবহ তৈরির চেষ্টা করেছেন তিনি। আর এতে লোকগীতির এক সুরেলা রোমান্টিক ঢং উঠে এসেছে। গানটি যে আদলে গাওয়া হয়েছে, তা সারি গানের কথাই মনে করিয়ে দেয়। শ্রমিকেরা ছাদ পিটিয়ে কিংবা বইঠার তালে তালে অথবা কাস্তের ঘাইয়ে যেভাবে গান গায়, যেন সেভাবেই শিল্পীরা কারাগারের তালা ভাঙতে চাইছেন।
তবে মূল গানের বিধ্বংসী শক্তির ব্যাপারটি নতুন সংস্করণের সুরে একেবারেই অনুপস্থিত। আর এতেই চটেছেন সবাই।
এ আর রহমানের সোশাল মিডিয়ার দিকে নজর ছিল সকলেরই। রবিবার দীপাবলির শুভক্ষণে দেখা গেল তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে জ্বলজ্বল করছে সেই ছবির নাম, যে ছবির গানের জন্য তিনি বিতর্কে জড়িয়েছেন। টিম ‘পিপ্পা’র পাশাপাশি সকলকে দিওয়ালির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রহমান। আমাজন প্রাইমে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পিপ্পা’ ছবি যে এক থেকে দশের মধ্যে ট্রেন্ড করছে, রহমানের পোস্ট থেকেই জানা গেল।
সিনেমার দুই মুখ্য চরিত্র ইশান খট্টর, ম্রুণাল ঠাকুর-সহ পরিচালক রাজা মেনন, সকলকে নাম ধরে ধরে শুভেচ্ছা জানালেও রহমানের পোস্টে কিন্তু নজরুলগীতি বিতর্ক নিয়ে একটা কথারও উল্লেখ নেই! বরং পালটা চলতি বিতর্কের মাঝেই গায়ক ‘পিপ্পা’র প্রশংসা করলেন।
বিতর্কিত গানটি ইউটিউবে প্রকাশের পর থেকেই রীতিমতো ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন শ্রোতারা। আর তাতে কমেন্ট করে এবং নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ঝাড়ছেন সবাই। আসছে বিচিত্র রকমের মন্তব্য। যেমন ইউটিউবের কমেন্টে একজন লিখেছেন, ‘মনটা জাস্ট ভেঙে গেল। এ আর রহমান এত সুন্দর গানটির পুরো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।’ আরেকজনের মন্তব্য, ‘সঠিক সুরে সঠিকভাবে গানটি বানালে ভালো হতো।
আসল গানটা শুনলে যে অনুপ্রেরণা পাই, তার সিকিভাগ এটা শুনে আসছে না।’ অন্য এক শ্রোতার বক্তব্য, ‘আসল গানটা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়, এটা কী বানিয়েছেন? জঘন্য।’ কেউ লেখেন আরও ভয়ংকর কথা—‘বিশ্বাস করতে পারছি না কোনো গানের আত্মাকে রহমান এভাবে খুন করতে পারেন!’, ‘ভীষণই বীতশ্রদ্ধ হলাম। কী যে খারাপ লাগছে শুনতে, কী আর বলি!’—এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই।