পুজো স্পেশাল বিভাগে ফিরে যান

ইতুপুজো: অগ্রহায়ণেই কেন পালিত হয় এই সূর্য ব্রত?

December 10, 2023 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলার সমাজে প্রচলিত লৌকিক প্রথার ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ইতুপুজো অন্যতম। ইতুপুজো যে আসলে সূর্য আরাধনা। ‘ইতু‘ শব্দটির উৎপত্তি হিসাবে মনে করা হয় সূর্যের নাম ‘মিত্র’ থেকে ‘মিতু’ থেকে ‘ইতু’ শব্দটি এসেছে। বাঙালি নারীরা শারীরিক ও মানসিক কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়েও এই ব্রত পালন করেন।

বর্তমানে বছরের সূচনা হিসেবে বৈশাখ মাসকে ধরা হলেও পূর্বে অগ্রহায়ণ মাস ছিলো বছরের প্রথম। অগ্রহায়ণ শব্দটি ‘অগ্র‘ এবং ‘হায়ণ‘ দুটি শব্দের সমষ্টি। অগ্র শব্দের অর্থ আগে বা শুরু। ‘হায়ণ‘ শব্দের অর্থ বৎসর বা বছর। বাঙালির জীবনে এই মাসটি সমগ্রভাবেই সূর্যের কাছে নিবেদিত। দিনের শুরু যেমন সূর্য প্রণামের মধ্যে দিয়ে করা হয়, তেমনই বছরের সূচনা সূর্যের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে করা রীতি ছিল বাঙালির সমাজে। গোটা অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে চলে ইতু পুজো বা সূর্যপুজো।

সূর্যের প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়েছে “ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম । ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্“ এবং মিত্রকে স্মরণ করে বলা হয়, “ওঁ মিত্রায় নমঃ“

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে বাংলার নারীরা কার্তিক মাসের শেষ দিন থেকে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে প্রতি রবিবার ইতুপুজোর অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন বিশেষ পুজোর মাধ্যমে ইতুপুজোর সমাপ্তি হয়। এই পুজোয় ব্রতীরা মাছ-মাংস খায় না, মাথার চুলে তেল মাখেন না।

‘ইতুর মালসা‘ শব্দটির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায় সূর্যের জন্যেই এই মালসা বা সরা উৎসর্গীকৃত। এই জন্য সূর্যাস্তের সাথে সাথে মালসাটিকে ঢেকে দেওয়া হয়। মাটি ভরা একটি সরাতে চারটি মাটির ছোট পাত্র রাখা হয়। এরপর মাটিতে ধান, যব, গম প্রভৃতি শস্যের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে তাতে জলের ছিটে দেওয়া হয়। প্রতি রবিবার ওই মাটিতে সামান্য জল দেওয়া হয়। পরে দেখা যায় বীজগুলি থেকে অল্প অল্প অঙ্কুর বের হচ্ছে। চারটি মাটির পাত্র সূর্যসৃষ্ট চার ঋতু ও মাটি ভর্তি বড় পাত্রটি সূর্যশাসিত পৃথিবীর প্রতীক।

পুজোর উপকরণ হিসেবে দেওয়া হয় ফুল, দূর্বা, চন্দন, তিল, রোদে শুকনো ধান, হরীতকী ইত্যাদি। জলপূর্ণ মাটির পাত্রে ধানের শীষের গুচ্ছ ও কয়েকটি গোলাকৃতি মূল। ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো শুরু করে আগের পাত্রের উদ্দেশে পুজো-সামগ্রী অর্পণ করলে বিবাহিত ও কুমারী মেয়েরা সূর্যদেব সম্পর্কিত ছন্দোবদ্ধ স্তবক ও লৌকিক উপাখ্যান আবৃত্তি করে।

অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন দেওয়া হয় ইতুর সাধ‌। ঘটে দই, দুধ, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে পূরণ করা হয়। তারপর সেই ঘটের মধ্যে আমপাতা, বেলপাতা, দূর্বা ইত্যাদি দেওয়া হয়। এই সাধ দেওয়ার সময় নানা মন্ত্র উচ্চারণ করেন ব্রতীরা। তার মধ্যে অন্যতম হল

“চালকটা দিয়ে রাঁধল সখী
ভাতকটা দিই খাই
কড়ির চুপড়ি মাথায় করে
গয়লা বাড়ি যাই
গয়লাভাই, গয়লাভাই
ঘরে আছো ভাই?
আমার ইতু সাধ খাবে
ভালো দুধ চাই।”

মানুষের বিশ্বাস ইতুপুজোর মাধ্যমে সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করা যায়। এই পুজোর উপাখ্যান ও আবৃত্তির শেষে কবিতার মতো করে কতকগুলো কথা বলেন ব্রতীরা। তাতে বলা হয় এই কবিতা শ্রবণে নির্ধনের ধন হয়, অপুত্রের পুত্র হয়, কুমারীর স্বামী হয়, অল্প দৃষ্টিশক্তি পায়, নিঃসহায় ভগবৎ সাহায্য পায় এবং মৃত্যুর পর স্বর্গলাভ হয়।

যেমন নারীরা বলে থাকেন

“ইয়তি (ইতু) ইয়তি নারায়ণ
তুমি ইয়তি ব্রাহ্মণ
তোমার মাথায় ঢালি জল
অন্তিমকালে দিও ফল।”

এই ব্রতে শিশুকন্যা ও নারীরা ব্রতী হয়, পুরুষরা অংশগ্রহণ করতে পারেন না। একমাত্র মূল পুজোতেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত ধরা হয়। তাই ইতুপুজোর গভীরে আজও বেঁচে আছে প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ঐতিহ্য।

তথ্য সূত্র:

১) বাংলার লোক উৎসব– দুলাল চৌধুরী

২) বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব – নীহাররঞ্জন রায়

৩) হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ (প্রথম পর্ব) – ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #Bengali Rituals, #rituals, #Itu Puja 2023

আরো দেখুন