পর্দা হোক বা জীবন, সহজ দিনযাপনই অনন্য করে তুলেছিল তুলসী চক্রবর্তীকে
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: পথের পাঁচালীর গুরুমশাই থেকে সাড়ে চুয়াত্তরের সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরা বোর্ডিং-এর মালিক বা একটি রাতের গোসাঁই জী থেকে পরশ পাথরের পরেশ দত্ত; তিনি বাংলা ছায়াছবির দিকপাল অভিনেতা। ছবি বিশ্বাসও তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতাকে সমীহ করতেন। চাওয়া পাওয়া, একটি রাত, অযান্ত্রিক, দ্বীপ জ্বেলে যাই… একটি ছবিও কী তাঁকে ছাড়া হত?
কিন্তু তাঁর শেষ দিন কাটল দুর্দশায়। হাওড়ার কৈলাস বোস থার্ড বাইলেনের সামান্য একটি বাড়িতে অভাব অনটনে কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলো। ট্রামে বাসে হাওড়া-টালিগঞ্জ যাতায়াত করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষারাণী দেবী ভিক্ষে দরজায় দরজায় ভিক্ষে করেছেন আমৃত্যু। অবসর সময়ে পৌরোহিত্য করে দুজনের সংসার চালাতেন। তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেও প্রবল সংবেদনশীল এই অভিনেতা অপরের সাহায্য ফিরিয়ে দিয়েছেন বার বার। উত্তমকুমার থেকে সত্যজিৎ, সকলের সাহায্যই ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনশোর বেশি বাংলা ছবি এবং কুড়িটিরও বেশি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করা এই কিংবদন্তী অভিনেতার মেলেনি প্রাপ্য সম্মান, কোথাও স্থাপিত হয়নি তাঁর মূর্তি। অভাবে পড়ে তাঁর স্ত্রী বেচে দিয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তীর পাওয়া সব পদক। শুকনো লঙ্কা ছবিটা দেখেছেন না? সেটাই তুলসীর জীবন এক সাক্ষাত শিল্পীর জীবন।
অভাব থাকলেও অভিনয়ের জন্য নূন্যতম টাকা নিতেন তুলসী চক্রবর্তী। ‘অবাক পৃথিবী’ ছবির সময় একবেলা কাজের জন্য তাঁকে দেওয়া হল তিনশো টাকা। তিনি কিছুতেই তা নেবেন না। কারণ, তখন তাঁর রেট দিনে একশো পঁচিশ টাকা। যা নিতেন তাইই নিলেন। নিজের কাজ সম্বন্ধে অত্যধিক বিনয়ী ছিলেন। প্রশংসা শুনলে বলতেন, ‘এই চরিত্র করার জন্য ভাল অভিনয় করার দরকার হয় নাকি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’
দলের অনেকের জামা-জুতো ছিঁড়ে গেলে নিজের হাতে সেলাই করে দিতেন তুলসীবাবু। সত্যি সত্যি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই পারতেন তুলসী চক্রবর্তী! নাটকে কখনও মোজায় চোখ এঁকে নাগরা জুতো বানিয়ে ফেলতেন। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ নাটকে তবলিয়া হঠাৎ কলেরায় অসুস্থ হয়ে পড়ায়, তাঁর বদলে তবলায় সঙ্গত করে দিলেন তুলসী চক্রবর্তী। যাকে বলে জ্যাক অফ অল ট্রেডস! নিঃসন্তান তুলসী বাবু মহানায়কে ‘ছেলে’ বলে ডাকতেন তরুণকুমারকেও তাই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলতেন ‘সৌমিত্তির’।
যে অভিনেতার অভিনয় প্রসঙ্গে বলতে গেলেই চার্লি চ্যাপলিনের কথা চলে আসে, স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যাঁকে ভারতের ‘মরিস শিভ্যালিয়র’ মনে করেছেন, কেমন ছিল সেই মহান অভিনেতার জীবন? কৃষ্ণনগরের গোয়াড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। অল্প বয়সেই বাবা মারা যাওয়ায় মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেই থেকে সংগ্রামী জীবনের সূত্রপাত, লড়াই আর লড়াই। কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর একটি অর্কেস্ট্রা পার্টি ছিল। ছোটোবেলা কেটেছিল এই কাকার কাছেই। তিনি স্টার থিয়েটারে কাজ করতেন। কাকার সঙ্গে থিয়েটারে যেতেন তুলসী, তখনই তাঁর মধ্যে অভিনয়ের প্রাথমিক আগ্রহ জেগেছিল। ছোটবেলায় কীর্তনের গাওয়ার সুবাদে গানের গলাটিও ছিল চমৎকার।
যে ক্ষমতার অনেকটাই দেখা যায় ‘পরশপাথরে’র সেই বিখ্যাত ‘ককটেল পার্টি’-তে। ছোটোবেলায় শেখা হারমোনিয়াম, তবলা, পাখোয়াজ সবই কাজে লেগেছিল তাঁর অভিনয় জীবনে। সার্কাসে শিখেছিলেন নানান রকম খেলা। নাচও জানতেন। মদের দোকানে বয়ের চাকরি থেকে সার্কাসের জোকার, ছাপাখানায় কম্পোজিটরের চাকরি কী না করেছেন তুলসী চাক্রবর্তী। এই সব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করতে করতে হাতে আসে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল। মাথায় অভিনয়ের ভূত জাঁকিয়ে বসল। অভিনয় করবেন বলে ৩২ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে মাসিক ৮ টাকা মাইনেতে স্টার থিয়েটারে ঢুকলেন। এটাই তুলসী চক্রবর্তীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেখানে শুরুতেই চোখে পড়ে যান কিংবদন্তি অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের।
স্টার, মনমোহন থিয়েটার, মিনার্ভা, রংমহল থিয়েটারে ৪০টির বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। পরিচিতি তৈরি হলে চলচ্চিত্রে ডাক পান। ১৯২০ সালে প্রথম নাটক ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৯৩২-এ প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুনর্জন্ম’। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি পেলেও, প্রথম দিকে তিনি কিন্তু সিরিয়াস অভিনয়ই করতেন। শ্রীচৈতন্যের শিক্ষাগুরু অদ্বৈতাচার্যের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের নজর কাড়েন।
একবার এক সিনেমায় বৈষ্ণবের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই পরিচালক তাঁকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী চক্রবর্তী শট দিলেন। খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমাতেও রাখলেন। অভিনয়ই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। নিছক পেশা নয়, অভিনয় শিল্পকে তিনি সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ তাঁকে ‘পরশ পাথর’ ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাকলেন, কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায় তাঁকে বেশি সাম্মানিক দিতে চাইলে তিনি জানিয়েছিলেন, বেশি টাকা থেকে নিলে ইন্ডাস্ট্রিতে আর কাজ নাও পেতে পারেন আর। সবাই মনে করতে পারে, তাঁর দর বেড়ে গেছে। স্বল্প পারিশ্রমিকেই যখন তাঁর দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটে যায়, হঠাৎ একটি ছবির জন্য বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে তাঁর কী লাভ! যদি আর কাজ না পান!
তাঁকে শ্যুটিং সেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য সত্যজিৎ গাড়ি পাঠালে তিনি বিশ্বাসই করতে চাননি যে, কোনও পরিচালক তাঁর জন্য গাড়ি পাঠাতে পারেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সত্যজিৎই একমাত্র তুলসী চক্রবর্তীর সঠিক মূল্যায়ন করেছিলেন। সাংবাদিক রবি বসুর লিখেছেন, ‘পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় তুলসীদা কেমন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন আমাকে বললেন, এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি।…এ আমি কী হনু রে!
তিনি এমনই মানুষ! তাঁর সারল্য আজ বিরল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, তিনি সত্যিই দুর্লভ মানুষ। কাজের প্রতি সততাই তাঁকে শ্বাশত করে রেখেছে। ছবি বিশ্বাস একবার বলেছিলেন, তুলসী চক্রবর্তী বিদেশে জন্মালে অস্কার পেতেন। না তাঁর অস্কার পাওয়া হয়নি। কারণ তিনি নিজেই যে পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের ছোটো ছোটো সাদামাটা চরিত্রগুলো অমূল্য রতন হয়ে গিয়েছে। তুলসী চক্রবর্তী যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তিনি ‘অস্কার’ পেতেন – এমনটাই মনে করতেন বিশ্ববরেন্য সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন, তুলসী চক্রবর্তী না থাকলে তিনি ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না। তিনি এতটাই অপরিহার্য ছিলেন।