সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়: প্রশ্ন করতেন, আদপেই একজন লেখক কিনা তিনি
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: ২১ ডিসেম্বর ১৯৯৩। তিনি লিখেছিলেন, “ঘুম থেকে উঠে ক্লান্ত লাগে এত। মিকি মাউসের কার্টুনে মিকির ওপর দিয়ে একটা রোলার চলে গেছে যেন। কাগজ হয়ে গেছি। ফুলে-ফেঁপে আবার মাউস হই। কী হল আমার”।
জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯৩৩ কলকাতায় | জিজ্ঞেস করলে বলতে পছন্দ করেন ‘ লেখাপড়া যত্রতত্র’ | পেশাগত সূত্রে জড়িত ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের সঙ্গে | জড়িত ছিলেন একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের সঙ্গেও | সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ হয় ২০০৫-এর ১২ ডিসেম্বর!
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল ক্রীতদাস ক্রীতদাসী (১৯৬১), সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৯), এখন আমার কোনো অসুখ নেই (১৯৭৭), হিরোশিমা মাই লাভ (১৯৮৯), কলকাতার দিনরাত্রি (১৯৯৬) ইত্যাদি। ৪০ বছরে লিখেছেন ৭০টি গল্প ,২১টি উপন্যাস এবং অসংখ্য না-কাহিনীমূলক নিবন্ধ | ১৯৯৫ তে পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার এবং ২০০২-তে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার |
মৃত্যর পর বেরিয়েছে তাঁর ডায়েরিটি, নাম ’সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি’। বই এর ব্যাক কভারে লেখা হয়েছে, ’দুঃসাহসী, অকপট, আনপ্রেডিক্টেবল। যা মনে করেছেন তাই লিখেছেন। গোটা বাংলা লেখালেখির জগৎকে ফালাফালা করেছেন। এমনকি বাদ যায়নি নিজেও। শুধু বিতর্কিত নয়, একই সঙ্গে গভীর, মননশীল, বুদ্ধিদীপ্ত। এই আনসেনসেরড ও আনএডিটেড সন্দীপন গুছিয়ে দেওয়া হল টীকাটিপ্পনীসহ।’
নিজের সম্বন্ধে কী বলেছিলেন সন্দীপন? দেখে নিন এখানে- [কৌরব, লিটল ম্যাগাজিন সংখ্যা, জুলাই ১৯৮৮-তে প্রকাশিত ]
যদিও ৩০ বছর ধরে লেখালিখি করে যাচ্ছি এবং ৭-৭টি বই-এর লেখক, এমন কি ৩টি প্রকাশের অপেক্ষায়, তবু, ‘কিন্তু, তুমি কি একজন লেখক?’— এই সামান্য প্রশ্নের সদুত্তর আমি এখনো জানি না। ‘হ্যাঁ’ বললেই ঐ প্রশ্নবোধক ফণাটি বুকে ছোবল মেরে ঢেলে দেবে কালনাগিনীর উগ্র বিষ— এই আমার ভয়। যে জন্যে নিরাপদ ‘না’ বলে থাকি। আমি জানি না, আমি আদপেই একজন লেখক কিনা।
‘না, তুমি একজন লেখক, আর বেশ ভালোই লেখে।,’ অনেকে আমাকে জানায়। পিতৃপরিচয়হীন সে রাধেয়কে জলস্রোত থেকে আমি কোলে তুলে নিতে পারি না। মনে হয়, আহা, লেখক কী, লেখা কী, তা এরা জানে না, তাই এমনটা বলছে। এরা অবোধ আর আমি বুদ্ধিমান এ-রকম ভেবে তাদের সমর্থন থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তারপর, যখন মনে পড়ে অব অল প্লেসেস ইন দ্যা ওয়ার্লড ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিস শহরে বসে ডাঃ স্যাট এন চ্যাটার্জির জড়িত কণ্ঠে সেই মুর্শিদাবাদী শ্লোক :
অবোধারে মারে বোধায়
আর বোদ্ধারে মারে খোদায়
তখন আমার নাথু-সঙ্কটে সত্যিই তিব্বতী হাওয়ার ঘূর্ণি ওড়ে। ঘূর্ণির মাথায় সেই কালনাগিনীর সরু, হিলহিলে খোলস উড়তে থাকে পতপত করে।
তবে, আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে, লেখক যদি বিন্দুমাত্র হয়ে থাকি, তাহলে আমি লিটল ম্যাগাজিনেরই লেখক। ‘বাংলা কবিতা সাপ্তাহিক’-এ ‘পঞ্চাশের লেখক ও খালি নৌকো’ শীর্ষকে আমার একটি ধারাবাহিক রচনা বের করার আগে সম্পাদক শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিজ্ঞাপনে আমাকে ঘোষণা করেছিল ‘লিটল ম্যাগাজিনের বিগ লেখক’—এই বলে। ওটাকেই মাঞ্জা দিয়ে পরে আর-একটি সেলাইবিহীন ছোট-কাগজ আমাকে ‘লিটল ম্যাগাজিনের প্রিন্স’ উপাধি দেয়। এ-সব ৬০-দশকের মাঝামাঝির কথা। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখনো ‘পদ্মশ্রী’ পান নি। এ থেকে বোঝা যাবে যে আমার কিছু ‘হয়নি,’ এটা ভুল ।
‘ছোট কাগজেই আমি লিখে গেছি’ একদিন এ কথা শুনে বড় কাগজের এক ভাবী ‘পদ্মশ্রী’ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে তেড়ে এলেন। বললেন, ‘না, তোমার দেশ-এ গল্প এবং আনন্দবাজারে উপন্যাস বেরিয়েছে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, একটা করে।’
এটাকে হার স্বীকার মনে করে বাম ও দক্ষিণে উপবিষ্ট দুই পারিষদকে ডান ও বাঁয়া তবলা-জ্ঞানে দুই চাটি মেরে উনি ‘কেমন, ঠিক বলেছি কিনা’ বোল তুললেন।
আমি বলতে চেয়েছিলাম, হ্যাঁ, একটা করে। আর দীর্ঘ ৩০ বছরে। এটা তো আরো বেশি করে প্রমাণ করে যে আমি ওদের লেখক নই। তাই নয় কী? যেমন ধরুন, কমলকুমার মজুমদার। উনি তো দেশ-এ দুটি গল্প লিখেছেন। কিন্তু, ওঁকে কি আমরা দেশ পত্রিকার লেখক ভাবি, না, নহবৎ, প্রতিবিম্ব, জর্নাল সত্তর বা কৌরবের লেখক ভাবি? ও, হ্যাঁ, অবশ্যই এক্ষণ-এর।
বড় কাগজে লেখবার প্রযত্ন করিনি মূলত নিজেরই গরজে। আমার প্রথর মৃত্তিকা-চেতনাই আমাকে বরাবর কাংসপাত্র থেকে দূরে রেখেছে। কেননা, বড় কাগজ মানে ইণ্ডাস্ট্রি আর এদের মূলধন হল লেখকের জনপ্রিয়তা। এবং কোন্ জনপ্রিয় লেখক এ-কথা না-জানেন যে, তাঁর জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছে তাঁর দুর্বল দিকগুলি নিয়েই ! বড় কাগজের যে কোনো সক্ষম লেখক সারা জীবন জুড়ে তাঁর এই দুর্বল দিকগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য। বাজার-এর দিকে লক্ষ্য রেখে ক্রমাগত লিখে যাবার বিপদটা এইখানে। একজন দুর্গোৎসবের বড় লেখক আমাকে একবার বলেছিলেন, যখন নিজেই নিজের লেখা আর বুঝতে পারব না মনে হয়, যখন সেনটেন্সগুলো ওপর থেকে সাঁ-করে নেমে যেতে চায় নিচের দিকে, যায়, তখন বুঝি আর নয়। তখন থামি। বুঝি, আজ আর লিখে লাভ নেই।’ উনি যা জানেন না, শোনেন নি, সেটা হল, বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুলের এক ক্লাস নাইনের মেয়ে আমাকে দুঃখ করে বলেছিল, ‘ওঁর বইগুলো আমরা আর লাইব্রেরিতে পাই না। ক্লাস সিক্সের মেয়েগুলো সব টেনে নিয়ে যায়।” এমনই ফুচকা !
তা, এত লিখে, এ-ভাবে দিনে লিখে, রাতে লিখে, দোলে লিখে, দুর্গোৎসবে লিখে, ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি পিছনে ফেলে, ইদুর-দৌড়ে ফার্স্ট হবার পর মহাকালদিদুর হাতে ‘হাতে-কালি মুখে-কালি বাছা আমার লিখে এলি ?’—এই ‘থুৎনিনাড়া পুরস্কার’—একে কি শেষ পর্যন্ত পণ্ডশ্রম বলে মনে হয় না?
প্রখর পণ্ডশ্রম চেতনাই আমাকে বরাবর বড় কাগজ থেকে দূরে রেখেছে। অনেকে মনে করেছেন, আমার কুঁড়েমি। বা, প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ আমাকে পাত্তা দেয় নি, তাই।
কিন্তু, তা সত্য নয়, না! বেশ পাত্তা দিয়েছিল।
আসলে, এ আমারই গরজ।
আমার মৃত্তিকা-চেতনা।
আমার মৃত্তিকা জীবন
~ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়