কুলুই মঙ্গল চণ্ডী ব্রত কী? গ্রাম বাংলায় কীভাবে হল প্রচলন?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গ্রাম বাংলায় অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে কুলুই মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত পালিত হয়। প্রচলিত রীতি অনুসারে এই দিনে উঠোনে আলপনা দিয়ে কুল গাছের ডাল পুঁতে ঘট বসাতে হয়। তারপর জোড়া কলা, জোড়া কুল, চিড়ে, গুড় ও ধান, ফুল, দুর্বার অর্ঘ্য সাজিয়ে উপাস্য দেবীর পুজো করা হয়। পুজো শেষে পাঁচজন সধবা নারীকে ব্রতকথা শুনিয়ে, মন্ত্র বলে ফলার খাওয়া হয়। জল পান ও ফলার গ্রহনের আগে স্ত্রীলোকেরা মন্ত্র পাঠ করেন। কলুই মঙ্গলচন্ডী ব্রতকথার শেষে বলা হয়েছে
“সোনার মঙ্গলচণ্ডী রূপোর বালা।
কেন মা মঙ্গলচণ্ডী এতো বেলা?
হাসতে খেলতে–পাটের শাড়ী পরতে,
তেল-হলুদ মাথাতে—আঘাটায় ঘাট করণীতে,
অসহ্য সহ্য করতে–রাজ্যহীনকে রাজ্য দিতে,
আইবুড়োর বিয়ে দিতে—হা-পুতির পুত্র দিতে,
নির্ধনেরে ধন দিতে—কানার চক্ষু দিতে
অন্ধেরে নড়ী দিতে তাই এতো বেলা।”
কুলুই মঙ্গল চণ্ডী ব্রত বহু প্রাচীন। এর নেপথ্যে রয়েছে প্রচলিত কাহিনী। একসময়ে এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণী এক গ্রামে বাস করত। তারা রোজ মা মঙ্গলচণ্ডীর ঘটে পুজো করত, পুজোর সরঞ্জাম সংগ্রহ করে দিত তাদের একমাত্র মেয়ে। একদিন ঠাকুরঘর পরিষ্কার করতে এসে মেয়েটি দেখল যে, একটা জোড়া কলা রাখা রয়েছে। সে ভাবল যে জোড়া কলায় তো আর পুজো হবে না, তাই মনে করে সে কলাটি খেয়ে ফেলল। এর ফলে মা মঙ্গলচণ্ডীর কৃপায় কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটির গর্ভবতী হল। কুমারী মেয়ের গর্ভ হয়েছে দেখে তার বাপ-মা সমাজের ভয়ে আর লোকলজ্জায় মেয়েটিকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করল।
মেয়েটি কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষে এক গভীর বনের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। সেখানে সে গাছের ডালপালা দিয়ে একটা কুঁড়ে ঘর তৈরী করে বাস করতে লাগল। কিছুদিন যাবার পর মেয়েটির দু’টি যমজ ছেলে হল। সে তাদের নাম রাখল আকুলী ও সুকুলী।বড় হয়ে দুই ভাই একদিন কাছেই নদীর তীরে খেলা করছিল। সেই সময় এক সওদাগর বাণিজ্যের পর সাতটি নৌকোয় ধন-রত্ন বোঝাই করে দেশে ফিরছিল। ছেলে দু’টি তাঁকে বলল, “আমরা বড় গরীব, আমাদের কিছু দিয়ে যাও।” সওদাগর বলল, “নৌকোয় শুধু গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই।” ছেলে দু’টি বলল, “তবে তাই হোক”। কিছুদূর যাবার পর সওদাগর দেখল যে, সত্যিই নৌকোয় গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই। তখন সে নৌকো ফিরিয়ে তক্ষুনি ছুটে এল ছেলে দু’টির কাছে আর তাদের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,- “বাবা! আমার সব গেছে, সর্বনাশ হয়েছে, আমার যেমন ছিল তোমরা আবার তেমনটি করে দাও বাবা তোমাদের পায়ে ধরছি আমি।”
ছেলে দুটি বলল যে, তারা এর কিছুই জানে না। তারা তাদের মার কাছে গিয়ে সব কথা বলার পর মা তখন মঙ্গলচণ্ডীকে সব কথা জানাল, মা মঙ্গলচণ্ডী দৈববাণী করে তখন সওদাগরকে বললেন,
“তুই আমার ব্রতদাসের অপমান করেছিস তাই তোর এই অবস্থা হয়েছে। তুই ঘরে ফিরে গিয়ে এখুনি মা কুলুই মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করার ব্যবস্থা কর, আবার তোর সব ফিরে পাবি।
পাঁচজন সধবা নারী এক জায়গায় বসে আকুলী, সুকুলীর কথা শুনে ফলার করবে। মা মঙ্গলচণ্ডীর কাছে যে যা প্রার্থনা করবে সে তাই পূরণ হবে। তার কুলেও কখনো কলঙ্ক পড়বে না।
সওদাগর বাড়িতে এসে খুব ঘটা করে ভক্তির সঙ্গে মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো আর ব্রত করার পর তার হারানো সব জিনিসই ফিরে পেল। এরপর একদিন মা মঙ্গলচণ্ডী আকুলী, সুকুলী আর তাদের মাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীকে দেবী বললেন, “তোদের মেয়ে মহাসতী। মঙ্গলবারে জোড়া কলা খেয়েছিল বলে আমার ইচ্ছেয় কুমারী অবস্থাতেই তার যমজ ছেলে জন্মেছে। আকুলী, সুকুলী নামে যমজ ছেলে দু’টি আমার ব্রতদাস, এদের যে অপমান করবে তার আর সর্বনাশের শেষ থাকবে না।” এই কথা বলে দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এর বেশ কিছুদিন পরে মা মঙ্গলচণ্ডী সেই দেশের রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, “তুই রাজপুত্রের সঙ্গে ওই ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়ে দে—তা না হলে তোর সর্বনাশ হবে।” রাজা ভীষণ ভয় পেয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ-কন্যার বিয়ে দিলেন। আকুলী-সুকুলীকে তখন সকলে দেবতার মত ভক্তি শ্রদ্ধা করতে লাগল। সেই থেকেই কুলুই মঙ্গলচণ্ডীর মাহাত্ম্যের কথা সারা বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।