বো ব্যারাক: কলকাতার অ্যাংলো পাড়ার জন্মকথা
সৌভিক রাজ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ক্রিসমাসে পার্ক স্ট্রিটের আজও শহরের আকর্ষণ। তবে এ কলকাতার আরও এক জায়গায় ক্রিসমাসের আসর বসে। শহরে বড়দিন মানেই কিন্তু শুধু পার্কস্ট্রিট নয়! আসুন শহরের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার গল্প বলি, না রিপন স্ট্রিট নয়। ছোট ছোট লাল ইটের বাড়ির পাড়ার নাম বো ব্যারাক’স। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের থাকার জন্যে এই ছোট ছোট বাড়িগুলি তৈরি হয়েছিল, সৈনিকদের কোয়াটার হিসেবে। কিন্তু মার্কিনীদের এ সব পছন্দ হয়নি, তারা ফোর্ট উইলিয়ামে চলে যান। আর তারপর মধ্য কলকাতার এ অঞ্চলে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার। বর্তমানে এর মালিকানা রয়েছে কলকাতা উন্নয়ন সংস্থার হাতে। বৌবাজার থানার পিছনে দেখা মেলে কলকাতার এই খ্রিস্টান পাড়ার। ছোট গলির এই পাড়ায় একশোর কাছাকাছি পরিবারের বসবাস। কিন্তু এই সাধারণ পাড়াও অসাধারণ আর মায়াবী হয়ে ওঠে শীতের আগমনে।
কলকাতার এ পাড়ায় কিন্তু ক্রিকেটের দেখা পাবেন না, দেখতে পাবেন সবাই হকি খেলছে। সবার হাতেই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা একটা করে হকি স্টিক…
কিন্তু এতো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এলো কোত্থেকে?
মূলত ব্রিটিশ রাজের কার্যকলাপের আউটকাম হিসেবে গড়ে উঠেছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজ, যাদের বাবা ইউরোপীয়, মা ভারতীয়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে শত্রুতা লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরা সেখানকার রাজাদের প্রস্তাব দিতেন অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধ পরিচালনা শেখানোর। সেইসব রাজ্যের রাজাদের অনুমতিতেই ব্রিটেন থেকে জাহাজে করে এদেশে আসতো সৈন্যদল, যাদের কাজ ছিল স্থানীয় সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এসবই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগের কথা। এই বিদেশ থেকে আগত ব্রিটিশ সৈন্যদের বলা হতো ‘ইয়েলো বয়েজ’, কারণ তাদের গলায় থাকত হলুদ স্কার্ফ। কখনও কখনও ‘টমি সোলজার’ নামেও ডাকা হত।
এইসব ‘টমি সৈনিকেরা’ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে এদেশে সংসার করতে শুরু করে এবং তাদের সন্তানরাই হল দেশের প্রথম অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।
ব্রিটিশরা অত্যন্ত চালাক জাতি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিকেরা রানী ভিক্টোরিয়াকে বোঝান, ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বেশি করে স্থাপন হলে, পরবর্তীকালে ব্রিটিশদেরই লাভ হবে। ব্রিটিশ শাসকদের ধারনা ছিল, এই ধরনর বিয়ের ফলে যে সব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সন্তানরা জন্ম নেবে, তারাই ভবিষ্যতে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব কাজ সামলাবে, এবং ভারতীয়দের দিকটাও ব্রিটিশদের চেয়ে তারা ভালো বুঝবে কারণ তাদের মায়েরা ভারতীয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসাহে উন্নতি করতে শুরু করেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এবং সফল হন বিভিন্নক্ষেত্রে, যেমন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে, চা শিল্পে উৎপাদনে। দেশের রেল ব্যবস্থার স্থাপনা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রেও অন্যতম অবদান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদেরই। তাদের এই উন্নতিতে অনেকেই খুশি হয়নি, কোম্পানিও না। তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, আর কলকাতার এই অংশে তারও অনেক পরে এদের আগমন হয় যখন ওই সেনা বাহিনীদের থাকার জায়গায় তাদের বদলে এরা থাকতে শুরু করেন। গড়ে ওঠে এই পাড়া, এদের নিজেদের ক্লাব যেমন রেঞ্জর্স ক্লাব ! আস্তে আস্তে তাদের ও শহরের সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এদের জন্য আমাদের আইনসভায় আসন সংরক্ষণ করা রয়েছে। ২রা আগস্ট পালিত হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দিবস।
এদের মধ্যে অনেকেই চলে গিয়েছেন দেশ ছেড়ে, তবু প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রয়েগিয়েছেন এই পাড়ায়। বড়দিনকে পৌঁছে দিয়েছেন লৌকিক উৎসবের স্তরে। এ পাড়া বিত্তবানের পাড়া নয়। সকলেই সাধারন জীবন জীবিকার জন্যে লড়েন। ক’বছর আগে এই বাড়িঘর ভেঙে ফেলে নতুন নতুন আকাশ ঝাড়ু বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু সব কিছুকে হারিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বো ব্যারাক’স…
কিন্তু এ পাড়ার আসল মজা হল বড়দিনে, প্রায় ন-দশ দিন ধরে চলে বড়দিনের উদযাপন। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় কেক পেস্ট্রি আর হোম মেড ওয়াইন। বাড়িতে তৈরি মদের কিন্তু বেশ চাহিদা। এর মধ্যে এক নম্বরে থাকে জিঞ্জার ওয়াইন, এছাড়াও গ্রেপস ওয়াইন, রেসিন ওয়াইন, পটেটো বিভিন্ন রকম বেরি থেকে তৈরী ওয়াইন। সারা বছর বোতলের ওয়াইন পাওয়া গেলেও এই ওয়াইনের জনপ্রিয়তা কিন্তু গগনচুম্বী। এই পাড়ার বাসিন্দারাই এই মদ বাড়িতেই তৈরি করেন এবং ক্রিসমাস ইভ ও তার কয়েকদিন আগে থেকেই পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রি করতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে কেক প্রেস্ট্রি তো আছেই, সেগুলিও হোম মেড। সারা শহর এবং রাজ্য থেকে মানুষ আসেন এই সব জিনিস কিনতে। রাস্তার দুধারে বাড়ির সামনে বা বারান্দায় টেবিল নিয়ে বসে চলে বিকিকিনির আসর।
জিঞ্জার ওয়াইন আর প্লাম কেক, সঙ্গে ডিসেম্বরে একচিলতে বো ব্যারাক’স। যা…চিরদিনের।