কলকাতার বড়দিনের ইতিহাস: সুতানুটি থেকে পার্ক স্ট্রিট
সৌভিক রাজ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: গোটা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বড়দিন। উৎসবের আমেজ থেকে বঞ্চিত নয় কলকাতাও। সাহবদের খাস তালুক ছিল ঔপনিবেশিক কলকাতা। চার্নক প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন ১৬৮৬-তে। তখন তিনি হুগলি ছেড়ে পালাচ্ছেন, বালেশ্বর যাবেন। পথে আশ্রয় নিলেন সুতানুটিতে। সুতানুটি তখন জঙ্গল-ঘেরা। গা ঢাকা দিয়ে ক’দিন কেটে গেল, দেখতে দেখতে ক্রিসমাস চলে এল। সে’বারই কলকাতায় প্রথমবারের জন্যে ক্রিসমাস উদযাপন হল। কলকাতা শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেভাবে জড়িয়ে আছে বড়দিন। সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাসে মিলে গিয়েছে সুতনুটি ও পার্ক স্ট্রিট।
আসুন সে দিনের একটা টাইম ট্রাভেল হোক। কেকে কামড় বসাতে বসাতে ঘুরে আসি সুতানুটি থেকে। লালমুখো সাহবরা তখন সবে মাত্র কলকাতা- গোবিন্দপুর- সুতানুটি আনাগোনা শুরু করেছে। ফন্দি ফিকির খুঁজছে কিভাবে জমিয়ে বসবেন। জোব চার্ণকেরও আগমন ঘটে গিয়েছে। বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন জোব, শায়েস্তা খাঁ তাকে সায়েস্তা করে দিল রীতি মতো। মোঘলদের তাড়া খেয়েই হুগলি ছেড়ে পালাচ্ছেন চার্ণক। বালেশ্বর যাবেন, হিজলীতে ঘাঁটি গাড়বেন। পথে আশ্রয় নিলেন সুতানুটিতে, সুতানুটি তখন জঙ্গলঘেরা এক এলাকা, সুতোর হাট। এইভাবেই গা ঢাকা দিয়ে দু-মাস কাটিয়ে দিলেন জোব। দেখতে দেখতে ক্রিসমাস চলে এল, সালটা ১৬৬৮ কলকাতায় প্রথমবারের জন্যে ক্রিসমাস উদযাপন হল। তখনও আজকের কলকাতা গড়ে ওঠেনি।
তবে এর এক শতাব্দী পরে শহরে শুরু হল জাঁকিয়ে ক্রিসমাস পালন। ততদিনে পলাশি জিতে ফেলেছেন ক্লাইভ। শহরে জাঁকিয়ে বসেছেন ইংরেজরা। হালের কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত বনেদি বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল ১৭৫৭ তে, ১৭৯০তে হুগলির গুপ্তিপাড়া শুরু করল বারোয়ারি পুজো। তারও ৭০-৮০ বছর আগে কলকাতায় শুরু হল ক্রিসমাস ভাবা যায়!
পলাশি ও বক্সার যুদ্ধ জিতেই ব্রিটিশ ভারতে তাদের পুরোদস্তুর শাসন কায়েম করেছিল। তারপর থেকেই কলকাতার বুকে অনুষ্ঠানিক ক্রিসমাস পালনের সূচনা। কলকাতা তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী, তাই রাজধানীর বড়দিন যে দেশকে পথ দেখিয়েছিল তা বেশ বোঝা যায়। বড়দিনের আগেই সাহেবরা বাড়িঘর ঠিকঠাক করতে শুরু করতেন ও চুনকাম করাতেন। ঘর গোছাতে শুরু করত। কলকাতার প্রথম আর্চবিশপ রেজিনাল্ড হেবারের লেখা থেকে জানা যায়, সেই সময় ডালহৌসি এবং চৌরঙ্গী অঞ্চলের প্রত্যেক সাহেব-বাড়িই দেবদারু গাছের ডাল, ফুল, লতাপাতা দিয়ে সাজানো হত।
১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট জনস চার্চে উপাসনা চলত প্রথমে। আর্মেনিয়ানদের অবশ্য আলাদা চার্চ ছিল। কিন্তু সাহেবদের সংখ্যা বাড়ায় স্থান সংকট দেখা দিল। ফলে কলকাতার পঞ্চম বিশপ, ড্যানিয়েল উইলসনের উদ্যোগে ১৮৩৯ সালে তৈরি হল সেন্ট ক্যাথিড্রাল চার্চ। আজকের আইকনিক চার্চ সেন্ট পলস অবশ্য এর হাফ যুগ পরে ১৮৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ের ক্রিসমাস ঔপনিবেশিক শাসনে উপজাত উৎসব। ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পরে তা অনেকটাই কলোনিয়াল হ্যাংওভার হয়ে গিয়েছিল। যেকোন উৎসবের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে খাওয়া দাওয়া। বড়দিনের খাওয়াতেও ইংরেজদের ছোঁয়া স্পষ্ট। ইংরেজরা সেকালের কলকাতায় বড়দিনে এক নতুন জিনিসের প্রচলন করেছিল। ইংরেজরা তাকে বলত ‘ডলি’। ডলি হল বড়দিনের উপহার বা ভেট। যা আর অন্য কোথাও দেখা যায় না, ডলি উপহার দেওয়ার প্রচলন হল এ শহরে। খুব সম্ভবত ডালি মানে আমরা পুজোতে ঈশ্বরের জন্যে যে অর্ঘ্য নিবেদন করি, তার থেকেই ডলি কথাটার জন্ম। এই ডলিই কেক প্রেস্ট্রিকে জনপ্রিয় করল আমাদের খাস কলকাতায়। এই ডলির মধ্যে থাকত কেক, পেস্ট্রি, মাছ, মাংস, ফল ইত্যাদি।
সাহেব বাড়ির বেয়ারা, খানসামা ও অন্য কাজের লোকেরা বড়দিনে তাঁদের ইংরেজ মনিবদের ‘ডলি’ বা ভেট পাঠাতেন। বড়দিনে ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ‘ডলি’ পাঠাতেন ইংরেজদের সঙ্গে কাজের সূত্রে যুক্ত কেরানি, বেনিয়া, মুৎসুদ্দি ও দালালরা।
কবি ঈশ্বর গুপ্তর লেখা ‘বড়দিন’ কবিতায় ডলি-র কথা এসেছে—
“খ্রীষ্টের জনম দিন, বড়দিন নাম
বহুসুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম
কেরানী দেওয়ান আদি বড় বড় মেট
সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট
ভেটকী কমলা আদি, মিছরি বাদাম
ভালো দেখে কিনে লয়, দিয়ে ভাল দাম।”
আজকের আমবাঙালির বড়দিন মানে হল চিড়িয়াখানা-ময়দানের ঘোরাঘুরি, আর কেক খাওয়া। কেকেরও বৈপরিত্য আছে, ফ্লুরিস, নাহুমস থেকে মনোতোষ বাড়ুয়ার বেকারির বাড়ুয়ায় কেক! আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটি বড় চমৎকার বুঝিয়ে দেয় বড়দিন।
চলুন আবার ইতিহাসে ফিরি, এবার পার্কস্ট্রিট। এ শহরের ক্রিসমাস আর পার্কস্ট্রিট, কার্যত সমর্থক। একসময়ের গোরস্থান যাওযার রাস্তা আলোয় আলোয় সেজে ডিসেম্বরের পার্কস্ট্রিট হয়ে ওঠে। রাস্তার দুধারে ছিল বাদাম গাছের সারি, তখন এর নাম রাখা হয়েছিল বাদামতলা। সেখান থেকে শহরকে সাহেবিয়ানা দেওয়ার রাস্তা পার্কস্ট্রিট হয়ে ওঠা কীভাবে?
ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেসিডেন্ট ও বাংলার গভর্নর হয়ে ১৭৬০ সালে হেনরি ভ্যানসিটার্ট কলকাতায় আসেন। ঐ বছর ২৭শে জুলাই দায়িত্ব নেন, তাঁর ঠিকানা হয় ৫, মিডলটন রো-এর বেশ বড়সড় তিনতলা একটি বাড়ি। প্রসঙ্গত, পরবর্তীকালে এই বাড়িটিই হয়ে যায় লরেটো হাউজ স্কুল, আজও সেটি স্কুলেরই অংশ। বাড়ির সঙ্গেই যুক্ত ছিল বিরাট এক বাগান এবং এই বাড়িতেই বেশ কিছু বছর থেকেছিলেন ভ্যানসিটার্ট। গভর্নরের কার্যকাল শেষ হওয়ার পরে ১৭৬৭-এ তিনি স্বদেশে ফিরে যান, যদিও হেনরি ভ্যানসিটার্টের এই বাগান বাড়ির ইতিহাস আরও প্রাচীন। এর মালিক ছিলেন উইলিয়াম ফ্রান্কল্যান্ড। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় তিনিই এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর এই বাড়ির বাসিন্দা হন হেনরি ভ্যানসিটার্ট, তিনিও ছেড়ে যাওয়া পর বাড়িতে এসে ওঠেন এলিজা ইম্পে, ফোর্ট উইলিয়ামের অধীনস্থ সেই সময়কার সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। শুধু এই পরিচয়ই নয়, তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশেষ খাতিরের বন্ধু ছিলেন এলিজা, নন্দকুমারের ফাঁসির মামলার বিচারক হিসেবে তিনি ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন। মিডলটন রো-এর বাড়ির, বড় বাগান বা ‘পার্ক’ থেকেই পার্ক স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় বলেই মনে করেন ঐতিহাসিক পি থাঙ্কপ্পন নায়ার। এক্কালে সেই বাগানে হরিণও চড়ে বেরিয়েছে! জটায়ু থাকলে হয়ত বলে উঠতেন হরিণ আশ্চর্য জানোয়ার মশাই!
এবার আরেক পাড়ার গল্প বলি। শহরে বড়দিন মানেই কিন্তু শুধু পার্কস্ট্রিট নয়! শহরের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার গল্প বলা যাক, না রিপনস্ট্রিট নয়। এই ছোট ছোট লাল ইটের বাড়ির পাড়ার নাম বো ব্যারাক’স। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের থাকার জন্যে কোয়াটার হিসেবে এই ছোট ছোট বাড়িগুলি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মার্কিনীদের এ সব পছন্দ হয়নি, তারা ফোর্ট উইলিয়ামে চলে যান। আর তারপর মধ্য কলকাতার এ অঞ্চলে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে কিছু অংলো ইন্ডিয়ান পরিবার। বৌবাজার থানার পিছনে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ বা অধুনা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-তেই আপনি দেখা পাবেন কলকাতার এই খ্রিস্টান পাড়ার। এ পাড়ার আসলো মজা হল বড়োদিনে, প্রায় নয় দশ দিন ধরে চলে বড়দিনের উদযাপন। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় কেক পেস্ট্রি আর হোম মেড ওয়াইন। এই বাড়িতে তৈরি মদের কিন্তু বেশ চাহিদা! এর মধ্যে পয়লা নম্বরে থাকে জিঞ্জার ওয়াইন, এছাড়াও গ্রেপস ওয়াইন, রেসিন ওয়াইন, পটেটো ওয়াইন বিভিন্ন রকম বেরি থেকে তৈরি ওয়াইন! বছরের এই সময় এই ওয়াইনের জনপ্রিয়তা কিন্তু গগনচুম্বী। এই পাড়ার বাসিন্দারাই এই মদ বাড়িতেই তৈরি করেন এবং ক্রিসমাস ইভ ও তার কয়েকদিন আগে থেকেই পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রি করতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে কেক প্রেস্ট্রি তো আছেই, সেগুলিও হোম মেড। সারা শহর এবং রাজ্য থেকে মানুষ আসেন এই সব জিনিস কিনতে। রাস্তার দুধারে বাড়ির সামনে বা বারান্দায় টেবিল নিয়ে বসে চলে বিকিকিনির আসর।
তবে এ পাড়ায় আসলে আপনাকে মিট লোফে খেতেই হবে। এছাড়াও আছে পেপার ওয়াটার অর্থাৎ তেঁতুলজলের সঙ্গে মেশানো জিরে, রসুন এবং অন্যান্য মশলা যা ভাত অথবা কাটলেটের সঙ্গে খাওয়ার রেওয়াজ। সেই সঙ্গে রয়েছে ঝাল ফ্রেজি, ভিন্দালু বা মালিগাটনি-র মতো চিরাচরিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবার। ইদানীং শহরের প্রায় কোনও রেস্তোরাঁতেই আর পাওয়া যায় না এসব খাবার! শুধুমাত্র এমন কিছু পরিবারে আজও এগুলি রাঁধা হয়। এছাড়াও রয়েছে ‘রোজ কুকি’, বড়দিনের সময় তৈরি বিশেষ ধরনের বিস্কুট, যার মধ্যে রয়েছে ময়দা, ডিম, এবং দুধ, যার সাথে আমাদের দক্ষিণ ভারতের ‘আচ্চু মুড়ুক্কু’র অনেক মিল রয়েছে। এখনও বড়দিন মানেই লাল ইটের বাড়ির ওলিতে গলিতে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে হারিয়ে যাওয়া। সাথে জিঞ্জার ওয়াইন আর প্লাম কেক, আর ডিসেম্বরে একচিলতে বো ব্যারাক’স। বো ব্যারাক’স ফরেভার …চিরদিনের!
২০১১ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই পার্ক স্ট্রিটে কলকাতা ক্রিসমাস ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হচ্ছে, যা শতাব্দী প্রাচীন কলকাতার বড়দিনের উৎসবকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কলকাতায় বড়দিনের উৎসবের বয়স মহানগরের বয়সের প্রায় সমসাময়িক। সময়ের সরণি বেয়ে কেটে গিয়েছে ৩৫০ বছর, স্বাধীনতা থেকে করোনা, তেভাগা থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক পালা বদল সব দেখে নিয়েছে কলকাতার বড়দিনের উৎসব। নিছক কলোনিয়াল হ্যাংওভার থেকে আজ তা আমাদের লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।