বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

নারীদের আধুনিকতা, অগ্রগতি এবং স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা সারদাদেবী

January 3, 2024 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: আজ সারদা মায়ের ১৭১ তম জন্মতিথি। বেলুড়মঠ সহ সারা বাংলাজুড়ে চলছে ‘সতেরও মা, অসতেরও মা’ রূপে তাঁর বিশেষ পুজো। একটা সময়ে নারী স্বাধীনতা, মেয়েদের শিক্ষা এবং প্রগতির নিখুঁত সেতুবন্ধন গড়েছিলেন মা সারদা। গৃহের কোণে থেকেও শক্তিরূপিণী মহামায়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরীদেবীর কন্যা সারদাদেবী (সারদামণি মুখোপাধ্যায়)। তাঁর জন্ম ২২ ডিসেম্বর। তিনি মাত্র ছ’বছর বয়স থেকে রামকৃষ্ণ পরমহংসের পত্নী, শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্ঘজননী, গোটা বিশ্বে তিনি ‘মা সারদা’ হিসেবে পরিচিত।

নারীশিক্ষা প্রসঙ্গে মা সারদা

মা সারদা, ছবি সৌজন্যে: rkmath.org

সারদা মায়ের ছোটবেলা কাটে জয়রামবাটি ও কামারপুকুরে। সেই সময়ের সমাজে স্ত্রীশিক্ষার চল ছিলনা। মেয়েরা পড়লে বিধবা হবে, দুর্ভোগ নেমে আসবে সংসারে—এই কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে হাত গোনা কয়েকজন নারী গোপনে পড়াশোনা জারি রেখেছিলেন। সারদা মা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সারদা মায়ের কথায়, “কামারপুকুরে লক্ষ্মী আর আমি ‘বর্ণপরিচয়’ একটু একটু পড়তুম। ভাগনে (হৃদয়) বই কেড়ে নিলে; বললে ‘মেয়ে-মানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই; শেষে কি নাটক-নভেল পড়বে।’ লক্ষ্মী তার বই ছাড়লে না, ঝিয়ারী মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে। আমি আবার গোপনে আর একখানি এক আনা দিয়ে কিনে আনালুম। লক্ষ্মী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত, সে ঘরে এসে আবার আমায় পড়াত।”

তিনি বলেছেন— “ভাল করে শেখা হয় দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তখন চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুরে। একাটি একাটি আছি। ভব মুখুজ্যেদের একটি মেয়ে আসত নাইতে। সে মধ্যে মধ্যে অনেকক্ষণ আমার কাছে থাকত। সে রোজ নাইবার সময় পাঠ দিত ও নিত। আমি তাকে শাক পাতা, বাগান হতে যা আমার এখানে দিত, তাই খুব করে দিতুম।”

নারীর দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর কথায় বারে বারে উঠে এসেছিল নারীর ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য শুধু ভাগ্যদেবতা বা ভগবানের নামে দোষ দিলে হবে না। নিজেকেই খণ্ডাতে হবে সেই বিধান।

নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মা সারদা

মা সারদা, ছবি সৌজন্যে: rkmath.org

এবারে আসি নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। ১৯১৭ সালে যুগান্তর বিপ্লবী দলের স্বাধীনতা সংগ্রামী অমর চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল চক্রবর্তী ও ভূপেন্দ্রকুমার দত্তকে ইংরেজরা খোঁজ করছে। তখন তাঁরা ছিলেন পলাতক। এই তিন বিপ্লবীকে রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিলজলা রেলওয়ে কেবিনের কর্মী দেবেন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিকন্যা সিন্ধুবালা দেবী। কলকাতা পুলিশ সেই খবর পেয়ে সেখানে যাওয়ার আগেই তিনজনই পালিয়েগিয়েছেন। পুলিস দেবেন ঘোষকে গ্রেপ্তার করল। তাঁর স্ত্রীকে অভিযুক্ত করল। কিন্তু তিনিও ততক্ষণে কলকাতায় থেকে ফেরার। চলে গিয়েছেন বাঁকুড়ার ইন্দাসে যূথবিহার গ্রামের গা ঢাকা দিয়েছেন। বাঁকুড়া পুলিশের হেডকোয়ার্টারে তাঁকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ পাঠানো হল। পুলিশ সুপার ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় বিরাট ফোর্স নিয়ে সেই নারীকে গ্রেপ্তার করতে গেলেন। তবে একজন নয়, দু’জনকে। একজন দেবেন ঘোষের স্ত্রী সিন্ধুবালা দেবী এবং অন্যজন তাঁর বোন। দু’জনকেই গ্রেপ্তার করা হল। একজনকে সাবাজপুর থেকে। অন্যজনকে যূথবিহার থেকে। পুলিশের জিপে না তুলে এই দুই নারীকে হাঁটিয়ে পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত আনা হয়। তারপর তাঁদের জায়গা হলো বাঁকুড়ার জেলে।

দেবেন ঘোষের স্ত্রী সিন্ধুবালা দেবী তখন ছিলেন গর্ভবতী। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য তিনি এসেছিলেন বাপের বাড়ি। (অন্য তথ্য অনুযায়ী সিন্ধুবালা দেবী নয়, তাঁর বোন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা)। এই অবস্থায় এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে আসার ঘটনায় বাংলাজুড়ে বিপুল প্রতিবাদ হয়। মহিলাদের প্রতি পুলিশের এই নির্যাতনের কথা লোকমুখে জানতে পেরে সারদা মা শুনে অত্যন্ত রেগে যান। সংবাদবাহককে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বলো কী? এটা কি কোম্পানির আদেশ? না পুলিশ সাহেবের কেরামতি? নিরপরাধ স্ত্রী লোকের উপর এত অত্যাচার মহারানি ভিক্টোরিয়ার সময় তো কই শুনিনি?’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘এই যদি কোম্পানির আদেশ হয়, তো, আর বেশি দিন নয়। এমন কোনও বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না, যে দু’চড় দিয়ে মেয়ে দু’টিকে ছাড়িয়ে আনতে পারে?’’ কিছু পরে সেই মহিলারা মুক্তি পাওয়ার খবর পেয়ে তিনি স্বস্তি পেলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘‘এই খবর যদি না পেতুম, তবে আজ আর ঘুমুতে পারতুম না।’’

বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে মা সারদা

মা সারদা, ছবি সৌজন্যে: rkmath.org

বাল্যবিবাহের তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। নিবেদিতার স্কুলে দুটি মাদ্রাজি বয়স্ক কুমারী মেয়েকে দেখে একই সঙ্গে মা আনন্দিত ও দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন, “আহা, তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আটবছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও,পরগোত্র করে দাও!’ আহা! রাধুর যদি বিয়ে না হত তা হলে কি এত দুঃখ-দুর্দশা হত?”

সারদা মা বিশ্বাস করতেন স্বাবলম্বিতা ছাড়া মেয়েদের স্বাধীনতা কখনও আসবে না। মেয়ের বিয়ে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করায় এক স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, “বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কী হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ এক চিঠিতে তাঁর এক গুরুভাইকে লিখেছিলেন, ‘মা-ঠাকুরণ কী বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না।… মা-ঠাকুরণ ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে।”

আজ শুধু বাঙালি নয়, দেশে-বিদেশেও মা সারদার ভাবনা বিশ্বজনীন। তিনি অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন গোটা পৃথিবীর মা। স্বামীজি একসময় তাই বলেছিলেন “মনে ভাববে, আর কেউ না থাক, আমার একজন মা আছেন।”

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#modernity, #Women, #freedom, #Sarada Maa, #progress

আরো দেখুন