প্রয়াত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী উস্তাদ রাশিদ খান
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: প্রয়াত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী উস্তাদ রাশিদ খান। বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। মূলত শাস্ত্রীয় সংগীত গাইলেও ফিউশন, হিন্দি ও বাংলা ছবিতে জনপ্রিয় গানও গেয়েছেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তর প্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রশিদ খানের।
শুরুতে মামা ওস্তাদ নিসার হোসেন খানের (১৯০৯-১৯৯৩) কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন রশিদ। রশিদ খান এগারো বছর বয়সে প্রথম কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরের বছর, ১৯৭৮-এ তিনি দিল্লিতে আইটিসি’র একটি কনসার্টে পারফর্ম করেন। ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে, যখন নিসার হুসেন খান কলকাতাক আইটিসি সঙ্গীত গবেষণা একাডেমিতে (এসআরএ) চলে আসেন , তখন রশিদ খানও ১৪ বছর বয়সে ওই একাডেমিতে যোগ দেন। তার পর থেকেই কলকাতাই তাঁর বাসস্থান, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
পণ্ডিত ভীমসেন জোশী একবার মন্তব্য করেছিলেন- রশিদ খান হলেন “ভারতীয় কণ্ঠ সঙ্গীতের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা”। তিনি ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী পান। পাশাপাশি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারেও ভূষিত হন । তিনি ২০২২ সালে শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণে ভূষিত হন। তাঁর জন্ম উত্তরপ্রদেশে হলেও তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন বাঙালি। তাই তো পদ্মভূষণ পাওয়ার সময় তাঁর নামের পাশে যখন উত্তরপ্রদেশ লেখাছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘উওরপ্রদেশ ভারতের মধ্যেই। ওখানে আমার জন্ম। তবে কর্ম বাংলায়। পুরস্কার আমাদের বাংলাতেই আসছে। আমি এই নিয়ে ভাবি না।’
উস্তাদ রাশিদ খান তাঁর উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কাছে প্রাথমিক তালিম পেয়েছিলেন। তবে রাশিদ খানের গাওয়া ছায়ানট রাগের ‘ঝনক ঝনক ঝন নন নন নন বাজে বিছুয়া’ বন্দিশটি যাঁরাই শুনেছেন তাঁরা জানেন, রাগটি তিনি অবিকল উস্তাদ নিসার হুসেন খানের ধরনে পরিবেশন করেননি। উস্তাদ নিসার হুসেনের গাওয়া এই বন্দিশটি দ্রুত্ তিন তালে নিবদ্ধ। অন্য দিকে উস্তাদ রাশিদ খান বন্দিশটি গেয়েছেন মধ্য লয়ে— অনেক ধীরে চলেছেন তিনি। গানের প্রথম শব্দ ‘ঝনক’ কথাটিতে মধ্য সপ্তকের আরম্ভের সা থেকে মন্দ সপ্তকের পঞ্চম পর্যন্ত নেমে গিয়ে আবার উঠতে থাকে বন্দিশটি। এই অংশে রাশিদ খানের কণ্ঠের গম্ভীর মন্দ্রতা যেন এই বন্দিশটির সূচনায় এক সতেজ সুরদীপ্তি দেয়। আবার মালবিকা কাননের গাওয়া ছায়ানট-এর একই বন্দিশ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বুঝবেন বড় বড় শাস্ত্রীয় শিল্পীর গান শুনতে শুনতে রাশিদ খান তৈরি করেছেন তাঁর নিজস্ব এক গায়কী। তাঁর মারওয়া রাগে গাওয়া ক্যাসেটটির বিলম্বিত অংশে উস্তাদ আমির খানকে মনে পড়েছিল বটে— কিন্তু সে-ক্যাসেট বেরিয়েছিল তিরিশ বছরেরও বেশি আগে। পরে আর ওই বিলম্বিত বিস্তারের ধরন রাশিদ খানের গানে প্রবেশ করতে পারেনি।
তাঁর আরও দু’টি বড় গুণবাচক দিক বিভিন্নসময় শ্রোতাদের কানে ধরা পড়েছে— তা হল একই রাগ, তিনি দু’বার ঠিক একই রকম ভাবে পরিবেশন করেন না, রাগটিকে প্রতিবার নতুন রাস্তায় এগিয়ে নেওয়ার দিকে তাঁর সুরকল্পনা কাজ করে। শ্যামকল্যাণ রাগে তাঁর যে সিডি পাওয়া যায়, সেখানে আরম্ভে, আওচারের সময়ে তীব্র মধ্যমটি লাগান একটু দেরি করে। শ্রোতাদের আকুলতা বাড়িয়ে তবে পৌঁছন কড়িমা পর্দাটিতে। আবার কলামন্দিরে একবার শ্যামকল্যাণ রাগে তীব্র মধ্যমে আসতে এতই সময় নিলেন তিনি যে শ্রোতারা ব্যাকুল উঠলেন। উস্তাদ শাহিদ পারভেজের সেতারের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দির রেকর্ডটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে— রাগ বাগেশ্রীর রূপায়ণে দু’জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না— বরং ছিল রাগটির রূপমাধুর্যকে খুলে ধরা, ছিল নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ সুরের রাস্তা ধরে ধরে এগোনো।
মাতৃভাষা বাংলা না-হলেও, তিনি যখন গেয়েছেন, ‘কার মিলন চাও বিরহী’, কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু’, তখন মুগ্ধ হয়েছেন শ্রোতারা। তাইতো বাংলার ঘরে ঘরে শ্রোতাদের মনে সঞ্চিত আছে তাঁর সুর, যা চিরকালীন।