প্লেগ পীড়িত কলকাতাকে রক্ষা করেছিলেন বিবেকানন্দ
সৌভিক রাজ
আজ থেকে ১২৫ বছর পিছিয়ে যেতে হয় আমাদের, তিলোত্তমায় তখন বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এসেছে। সঙ্গে এসেছে মরণ রোগ প্লেগ! মৃত্যু মিছিলে কলকাতার জন জীবনে ঠান্ডা নেমে এসেছে। ১৮৯৮-এর এপ্রিল-মে মাস নাগাদ কলকাতায় প্রথম প্লেগের আবির্ভাব। তবে ভারতে প্লেগ ঢুকেছে আরও অনেক আগে ১৮৯৬ নাগাদ। গোট পৃথিবীও এর আগে একাধিকবার প্লেগের আঁচড় দেখে ফেলেছে।
এ দেশে বোম্বে আধুনা মুম্বাই শহরে প্রথম হানা দেয় প্লেগ। প্রায় দুই বছর ধরে মুম্বাই থেকে গুজরাত, কচ্ছ ও পাঞ্জাব এবং মাদ্রাজ পেরিয়ে ১৮৯৮ সালে প্লেগ কলকাতায় এসে থাবা বসাল।
শুরু হল হাহাকার, টিকাই ছিল প্লেগের একমাত্র ওষুধ, কিন্তু মানুষ তা নিতে রাজি হয়নি। টিকাকরণ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। অশিক্ষা, অসচেতনা ছিলই, সেই সঙ্গে উপড়ি যোগ হল কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস।
ভারতীয়দের নানা কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্লেগের সময়ও যায়নি। টিকা নিয়ে তদানিন্তন কলকাতাবাসীর অযৌক্তিক প্রচারণাও ছিল। দেশীয়দের মধ্যে রটে যায় টিকা নিলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। টিকাকরণের নামে ম্লেচ্ছ ইংরেজ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবে এবং নারীদের শ্লীলতা হরণ করবে, এই আশঙ্কাতেই টিকাকরণের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশ সরকার সপ্তাহে দু-দিন বাড়িতে এসে টিকা দেবে। এর বিরুদ্ধে অনেকেই রুখে দাঁড়িয়েছিল। রাজপথে ঘুরতে থাকে লাঠি, স্লোগান উঠতে থাকে জায়গায় জায়গায়। সেই সময় উডবার্ন সাহেব টিকাকরণের জন্য খুব চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি। আজও কলকাতায় তার নামে রাস্তা রয়েছে উডবার্ন পার্ক রোড।
শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে সাধারণ মানুষ, ১৮৯৮-এর ৪ঠা মে অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, “কলকাতা এক পরিত্যক্ত নগরীর চেহারা নিয়েছে।” ফের ৮ই মে এক সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছে, “ট্রেনে, স্টিমারে, পথে শুধু দেখা যায় প্রবাহিত বিপুল জনতরঙ্গ। কয়েকদিনের মধ্যে ২ লক্ষ মানুষ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। ধনী পর্দানশীনা মহিলাও পর্দা বন্ধন সরিয়ে রাস্তায় ছুটছেন-মারাত্মক শহর থেকে বাঁচবার জন্যে।”
দীপেশ চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায়, মুম্বাইতেও টিকার বিরুদ্ধাচারণ হয়েছিল। বাড়ির মহিলাদের বলপূর্বক হাসপাতালে ভর্তি করার অভিযোগে ১৮৯৬ সালের ২০ অক্টোবর এক হাজার শ্রমিক আর্থার রোডের হাসপাতাল আক্রমণ করেন।
কলকাতার মুসলমান সমাজে রটে যায়, ব্রিটিশ সরকার হজ আটকাতেই এই ব্যবস্থা করেছে।
এই সময়ে প্লেগ নিয়েও একদল মানুষ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে শুরু করে, ‘প্লেগ প্রহসন’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে, এই মর্মে অমৃতবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
কলকাতাবাসীর এহেন আচরণে সীমাহীন বিপর্যয় নেমে আসে। প্লেগের আক্রমনে কলকাতা উজার হয়ে যায়। শহরে জাঁকিয়ে বসে প্লেগ যখন ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন স্বামী বিবেকানন্দ।
১৮৯৮-এর এপ্রিলের শেষভাগে কলকাতায় প্লেগের প্রকোপ শুরু হল। ১৭ই এপ্রিল বাংলায় প্রথম প্লেগের কারণে মৃত্যু হয়। কাপালিটোলা লেনের এক বাসিন্দার দেহ ময়নাতদন্ত করে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে আসেন- প্লেগের কারণেই মৃত্যু হয়েছে। বেনিয়াপুকুর, বড়বাজার, কুমারটুলি, শ্যামপুকুরে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। ৩০ই এপ্রিল ব্রিটিশ প্রশাসন জানিয়ে দেয়, কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
স্বামীজি তখন দেশ ফিরে সবে মাত্র দার্জিলিং গিয়েছেন, তাঁর শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বেঁধেছে। তাঁর শরীর ভগ্ন।
২৯শে এপ্রিল বিবেকানন্দকে ব্রহ্মানন্দ চিঠিতে লেখেন, “কলিকাতায় ৪-৫ দিনের মধ্যে ১০-১২টি প্লেগ কেস হইয়াছে। তাহাদের মধ্যে ৮-১০ জন মারা পড়িয়াছে। বাকিদের জীবনের আশা খুব কম…।” চিঠিতে স্বামীজির শহরের খবর দিলেও, ঐ শরীরে বিবেকানন্দ কলকাতায় আসুক তা চাননি ব্রহ্মানন্দ অর্থাৎ রাখাল মহারাজ। স্বামী অখণ্ডানন্দের লেখায়, এই সময় সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। স্বামী অখণ্ডানন্দের বয়ানে, “স্বামীজির সঙ্গে দার্জিলিং-এ আছি। সকালে দেখি একেবারে গম্ভীর। সারাদিন কিছু খেলেননা, চুপচাপ। ডাক্তার ডেকে আনা হলো, কিন্তু রোগ নিরুপণ করা গেলো না। একটা বালিশে মাথা গুঁজে রইলেন সারাদিন। তারপর শুনলাম কলকাতায় প্লেগ, তিনভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, শুনে অবধি এই। সেই সময় স্বামীজি বলেছিলেন, সর্বস্ব বিক্রি করেও এদের উপকার করতে হবে। আমরা যে গাছতলার ফকির, সেইখানেই থাকব।”
ম্যাকলাউডকে ২৯শে জুলাই একটি চিঠিতে স্বামীজি লিখেছিলেন – ‘আমি যে শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকারকল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি।’
জন্মভূমি মহামারিতে বিধ্বস্থ, সবার নিষেধ উপেক্ষা করে ৩রা মে কলকাতায় ছুটে এলেন স্বামীজি। অন্যদিকে, প্লেগ প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করতে ২ তারিখ তদানিন্তন কলকাতার ৩ নং ওয়ার্ডে করদাতাদের সভা ডাকা হয়েছিল। পৌরসভার সাফাইকর্মীরা ধর্মঘট করবে বলে ঠিক করে ফেলেছেন, পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সরকার ঘোষণা করে দিল কলকাতার প্লেগ “প্রায় আয়ত্বে”। তারপর ৬ই মে তাঁরা কাজে যোগ দিলেন সাফাইকর্মীরা।
কলকাতায় ফিরে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে (ওটাই তখন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয়) সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী ও অনুগামীদের নিয়ে স্বামীজি এক সভা করেন এবং বলেন, “দেখো, আমরা সকলে ভগবানের পবিত্র নাম নিয়ে এখানে মিলিত হয়েছি। মরণভয় তুচ্ছ করে এই সব প্লেগ রোগীদের সেবা আমাদের করতে হবে। এদের সেবা করতে, ওষুধ দিতে, চিকিৎসা করতে আমাদের নতুন মঠের জমিও যদি বিক্রি করে দিতে হয়, আমাদের যদি জীবন বিসর্জনও দিতে হয়, আমরা প্রস্তুত।” প্লেগ হাসপাতাল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় তখন প্লেগের দাপট। মানুষ কলকাতা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে, স্বামী বিবেকানন্দ মানুষগুলোকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন, কারণ অজান্তেই তারা রোগ জীবাণু বহন করছিল। গ্রামবাংলার প্লেগ ছড়ালে উজার হয়ে যেত বঙ্গ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখুন। সবাই একবার মরে যাবে। কাপুরুষরা কেবল নিজের মনের ভয়ের কারণে বার বার মৃত্যুর যন্ত্রণায় ভুগছে। আসুন, আমরা এই মিথ্যে ভয় ছেড়ে দিতে পারি এবং ঈশ্বরের অসীম করুণায় বিশ্বাস রেখে, আমাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করুন। আসুন আমরা শুদ্ধ ও পরিষ্কার জীবনযাপন করি। রোগ, মহামারী ইত্যাদির ভয় একদিন আপনাদের ইচ্ছেশক্তির কবচের কাছে বাতাসে বিলীন হয়ে যাবে।’ পরের দিন থেকে নিবেদিতার সঙ্গে সেবাব্রতে নিযুক্ত হলেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের তরফে কমিটি গড়া হল। ঐ কমিটির সম্পাদিকা হলেন সিস্টার নিবেদিতা, প্রধান কার্যাধ্যক্ষ স্বামী সদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, স্বামী আত্মানন্দ এবং অনান্য কর্মীরাও ছিলেন। কলকাতার রাজপথ, বস্তি নিজের হাতে তাঁরা পরিষ্কার করেছিলেন।
স্বামী অব্জজানন্দ লিখে গিয়েছেন, “কলিকাতা নগরীর বস্তিতে বস্তিতে স্তূপিকৃত জঞ্জাল পরিষ্কার করিবার মতন যথেষ্ট সংখ্যক ঝাড়ুদার তখন কলিকাতায় ছিল না— যাহারা ছিল তাহারাও ভয়ে পলায়নপর। স্বামী সদানন্দ ঝাড়ু হাতে শহরের অলিগলিতে আবর্জনা পরিষ্কার করিয়া ফিরিয়াছেন, দুর্গন্ধময় ক্লেদপূর্ণ জঞ্জাল দিনের পর দিন অম্লান বদনে সাফ করিয়াছেন। সদানন্দ সকলকেই এমনকি ক্লিন শরীর মেথরকেও পরম সমাদর করিয়া আলিঙ্গন দিতেন। কোনো প্লেগরোগী অসহায় অবস্থায় কোথাও আছে শুনলেই, মূর্তিমান সেবার ন্যায় সদানন্দ তাহার শয্যাপার্শে ছুটিয়া যাইতেন তাহাকে পূর্ণ নিরাময় না করা পর্যন্ত আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া সেবায় মগ্ন হইতেন।” নর্দমা বা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা দেখে, সাফাইকর্মীরা যখন সরে যেত, সন্ন্যাসী সদানন্দ তখন তাদের হাত থেকে ঝুড়ি কোদাল কেড়ে নিয়ে এগিয়ে যেতেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সেবাকার্যের ইতিহাসে, চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সদানন্দ। তিনি ছিলেন ফ্রন্টলাইন মহামারি যোদ্ধা।
বিবেকানন্দের প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন নিবেদিতা। নিজের স্বাস্থ্যে পরোয়া করেননি, ভয়কে দূরে ঠেলে নিজে সশরীরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্লেগ আক্রান্তদের সেবায়। রাতের পর রাত প্লেগ আক্রান্ত বস্তিতে, রাস্তায় কাটিয়েছেন। জনস্বাস্থ্যরক্ষার জন্য কী কী করতে হবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করে যেতেন নিবেদিতা। নিবেদিতার ঐ উদ্যোগ নিজের চোখে দেখেছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সেসব দিনের কথা। সালটা ১৮৯৯, শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্লেগ ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর একদিন রোগী দেখে বাড়ি ফিরেছেন, দেখেন একজন বিদেশিনী তাঁর ঘরে বসে আছে। তাঁর দিনলিপি অনুযায়ী “তাঁহার পরিধানে গৈরিকবাস, গলদেশে রুদ্রাক্ষমাল্য, আননে দিব্যদীপ্তি।” সেই প্রথম নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ওইদিন সকালেই ডাঃ রাধাগোবিন্দ বাগবাজারের এক বস্তিতে একটি শিশুকে পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শিশুটির মা আগেই মারা গিয়েছে, শিশুটিও মারণ রোগাক্রান্ত। এই কথা শোনা মাত্র নিবেদিতা ছুটে যান সেখানে। নিজের সন্তানের মতোই বুকে তুলে নিয়েছিলেন শিশুকে। পরে রাধাগোবিন্দ কর দেখেন, “সেই অস্বাস্থ্যকর পল্লীতে, সেই আর্দ্র জীর্ণ কুটিরে নিবেদিতা রোগগ্রস্ত শিশুকে ক্রোড়ে লইয়া বসিয়া আছেন। দিনের পর রাত্রি রাত্রির পর দিন তিনি স্বীয় আবাস ত্যাগ করিয়া সেই কুটিরে রোগীর সেবায় নিযুক্তা রহিলেন।” নিজের স্বাস্থ্যের জন্য বিন্দু মাত্র চিন্তা করেননি। ঘর পরিষ্কার করতে হবে বলে নিজেই মই এনে চুনকামের কাজ করতে নেমে পড়েছিলেন। নিবেদিতা জানতেন, এই বাচ্চাটি আর বাঁচবে না। সে বাঁচেনি; কিন্তু নিজের সমস্ত স্নেহ উজার দিয়েছিলেন নিবেদিতা। শুধু একটি জায়গায় নয়, সর্বত্র। কখনও প্লেগ হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ করছেন, কখনও নিজেই অকুস্থলে পৌঁছে যাচ্ছেন। আবার দৃঢ় সংগঠকের কাজও করছেন, অর্থ সংগ্রহ করছেন, নিবেদিতা ইংরেজি খবরের কাগজে সেবাকার্যের অর্থ সংগ্রহের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ক্লাসিক থিয়েটারে মিশনের তরফে ডাকা এক সভায় স্বামীজীর উপস্থিতিতে ‘প্লেগ ও ছাত্রগণের কর্তব্য’ এই শিরোনামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। স্বেচ্ছায় অনেক ছাত্ররাই এগিয়ে এসেছিল। প্রতি রবিবার সন্ধেবেলা ৫৭ নং রামকান্ত স্ট্রিটে জড়ো হয়ে, নিবেদিতা ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন, কোন এলাকায় কী কর্মসূচি হবে তা ঠিক করে দিতেন। সচেতনতার প্রচার করতেন। এ কাজে পাশে পেয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিংবা জগদীশচন্দ্র বসুর মতো মানুষকে।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে মাঠে নেমে কাজ করতে গেলে বহু বিরোধিতা, সমলোচনা নিন্দার মুখে পড়তে হয়। বিবেকানন্দ কিন্তু পিছপা হননি। বুঝতে পেরেছিলেন, ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যবিধি পৌঁছে দিতে হবে,
গুজবের সঙ্গে লড়তে হবে তবেই প্লেগ হারবে। কলকাতাবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়ে একটি প্রচারপত্র তৈরি করার ভার পড়ে নিবেদিতার উপর। স্বামীজির নির্দেশেই দু’দিন ধরে সিস্টার নিবেদিতা প্রথমে ইংরেজিতে তা তৈরি করেছিলেন, তারপর তা বাংলা ও হিন্দিতে অনূদিত হয়।
স্বামী অব্জজানন্দ রচিত ‘স্বামীজীর পদপ্রান্তে’ গ্রন্থে শহরবাসীর প্রতি আবেদন পত্রটি পাওয়া যায়।
কলিকাতানিবাসী ভাইসকল! (প্রতি সম্বোধন)
১) আমরা তোমাদের সুখে সুখী ও তোমাদের দুঃখে দুঃখী, এই দুর্দিনের সময় যাহাতে তোমাদের মঙ্গল হয় এবং রোগ ও মারীভয় হইতে একি সহজে নিষ্কৃতি হয়, এই আমাদের নিরন্তর চেষ্টা ও প্রার্থনা।
২) যে মহারোগের ভয়ে বড়, ছোট , ধনী নির্ধন, সকলে ব্যস্ত হইয়ে শহর ছাড়িয়া যাইতেছে সেই রোগ যদি যথার্থই আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয় তাহা হইলে তোমাদের সকলের সেবা করিতে করিতে জীবন যাইলেও আমরা আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিব, কারণ তোমরা সকলে ভগবানের মূর্তি। তোমাদের সেবা ও ভগবানের উপাসনায় কোনও প্রভেদ নাই। যে অহঙ্কারে, কুসংস্কারে, অজ্ঞানতায় অন্যথা মনে করে, সে ভগবানের নিকট মহা অপরাধী ও মহাপাপ করে ইহাতে সন্দেহমাত্র নাই।
৩) তোমাদের নিকট আমার সবিনয় প্রার্থনা অকারণে ভয়ে উদ্বিগ্ন হইও না। ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া স্থিরচিত্তে উপায় চিন্তা কর , অথবা যাহারা তাহা করিতেছে তাহাদের সহায়তা কর।
৪) ভয় কিসের? কলিকাতায় প্লেগ আসিয়েছে বলিয়ে সাধারণের মনে যে ভয় হইয়াছে তাহার বিশেষ কোনও কারণ নাই। আর আর স্থানে প্লেগ যেরূপ রুদ্রমূর্তি হইয়াছিল, ঈশ্বরেচ্ছায় কলিকাতায় সেরূপ কিছু নাই। রাজপুরুষেরাও আমাদের প্রতি বিশেষ অনুকুল।
৫)এস, সকলে বৃথা ভয় ছাড়িয়া ভগবানের অসীম দয়াতে বিশ্বাস করিয়া কোমর বাধিয়া কর্মক্ষেত্রে নামি , শুদ্ধ ও পবিত্র ভাবে জীবনযাপন করি। রোগ ও মারীভয় প্রভৃতি তাঁহার কৃপায় কোথায় দূর হইয়া যাইবে।
৬)(ক) বাড়ি, ঘরদুয়ার, গায়ের কাপড় বিছানা, নর্দমা, প্রভৃতি সর্বদা পরিষ্কার রাখিবে।
(খ) পচা বাসি খাবার না খাইয়া টাটকা পুষ্টিকর খাবার খাইবে। দুর্বল শরীরে রোগ হইবার অধিক সম্ভাবনা।
(গ) মন সর্বদা উৎফুল্ল রাখিবে। মৃত্যু সকলেরই একবার হইবে। কাপুরুষ কেবল নিজের মনে ভয়ে বারম্বার মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেন।
(ঘ) অন্যায়পূর্বক যারা জীবিকা অর্জন করেন, যাহারা অপরের অমঙ্গল ঘটায়, ভয় কোনো কালে তাহাদের ত্যাগ করে না। অতএব এই মৃত্যুভয়ের দিনে এই সকল বৃত্তি ত্যাগ করিবে।
(ঙ) মহামারীর দিনে গৃহস্থ হইলেও কাম ক্রোধ হইতে বিরত থাকিবে।
(চ) বাজারে গুজবাদি বিশ্বাস করিবে না।
(ছ) ইংরাজ সরকার কাহাকেও জোর করিয়া টিকা দিবেন না। যাহার ইচ্ছা হইবে সেই টিকা লইবে।
(জ) জাতি, ধর্ম ও স্ত্রী লোকের পর্দা রক্ষা করিয়া যাহাতে আমাদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে নিজের হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা হয় তজ্জন্য বিশেষ চেষ্টার ত্রুটি হইবে না। ধনী লোক পালাক, আমরা গরীব। গরীবের মর্মবেদনা বুঝি। জগদম্ভা সকল নি:সহায়ের সহায়; মা অভয় দিতেছেন- ভয় নাই, ভয় নাই!
৭)হে ভাই, যদি তোমার কেহ সহায় না থাকে অবিলম্বে বেলুড় মঠে, শ্রীভগবান রামকৃষ্ণ দাসদিগের খবর পাঠাইবে। শরীরের দ্বারা যতদূর সাহায্য হয় তাহার ত্রুটি হইবে না। মায়ের কৃপায় অর্থসাহায্যও সম্ভব।
বিশেষ দ্রষ্টব্য- প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে পল্লীতে পল্লীতে মারীভয় নিবারণের জন্যে নাম সংকীর্তন করিবে।
(পত্রের ভাষা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)
স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লেখা সুবোধানন্দের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, প্রথম দফায় ১ লক্ষ প্রচারপত্র ছাপানো হয়েছিল।
এই পত্র বিলি করতে গিয়ে সন্ন্যাসীদের কম বিপদে পড়তে হয়নি। জুটেছে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, প্লেগ নিরাময়ে সরকারি নির্দেশ উল্লেখ করে বিবেকানন্দ রচিত লিফলেট বিলি করতে রাস্তায় বেরোলে অখণ্ডানন্দকে (পরে অখণ্ডানন্দ মুর্শিদাবাদে প্লেগের সেবা কাজ পরিচালনা করেছিলেন) মারতে পর্যন্ত গিয়েছিল জনতা। কারণ তাদের সন্দেহ হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন ইংরেজের হয়ে প্রচার করছে, সাধুর ছদ্মবেশে এরা ব্রিটিশের চর। অতএব মারো সাধুকে। অন্য সন্ন্যাসীদের তাড়া করা হয়েছিল। এর থেকে বিবেকানন্দও রেহাই পাননি।
সময়কালের নিরিখে, কলকাতার প্লেগের দুটি পর্যায় আছে। প্রথম দফায় প্লেগের সব ব্যবস্থা পাকা করে ১৮৯৮-এর ১১ই মে সদানন্দ ও নিবেদিতাকে নিয়ে স্বামীজি আলমোড়া যান। ১৩ মে ১৮৯৮ কলকাতায় ফের প্লেগ শুরু হল। কলকাতা জনমানবশূন্য, ব্যবসা বন্ধ, গাড়ি নেই রাস্তায়। সমস্ত রঙ্গমঞ্চ বন্ধ, স্টার থিয়েটার ৪০ দিন বন্ধ ছিল। ২০মে প্লেগে আতঙ্কিত সাফাই কর্মীরা আবার ধর্মঘট করল।
২৮ মে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে পুলিশ কমিশনার মিস্টার জেমসের উপস্থিতিতে প্লেগ নিয়ে বিশেষ আলোচনা সভা হল। জুলাই মাসে জন উডবার্ন বিভিন্ন প্লেগ হাসপাতাল পরিদর্শন করে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের এক সভায় বললেন, প্লেগকে বিদায় জানাবার সময় এসেছে। রোগের প্রকোপ স্থিমিত। ঐ বছর ১৮ই অক্টোবর উত্তর ভারত থেকে বেলুড়ে ফিরলেন স্বামী বিবেকানন্দ, শরীর ভাল নয়। ৯ই ডিসেম্বর ১৮৯৮ বেলুড় মঠের উদ্বোধন হল। কিন্তু ঝিমিয়ে পড়া মহামারি ১৮৯৯ সালে চরমে উঠল। ঐ বছর ৭ই মার্চ কলকাতায় আবার প্লেগ শুরু হল। একদিনে ৯৫ জন মারা গেলেন। এখান থেকেই দ্বিতীয় দফা শুরু হচ্ছে। ইতিহাস বলছে ১৮৯৯ জুড়ে প্লেগ দাপট চালায়, প্রতিদিনই মানুষ মারা যেত। ১৮৯৯-এর গুড ফ্রাইডে ৩১ মার্চ থেকে আবার মিশনের সেবাকার্য শুরু হল। স্বামীজির নেতৃত্বে মঠ ও মিশন ১৮৯৮ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত প্লেগের সঙ্গে লড়াই করেছে। ১৯০০ সালের শুরুতে হানা দেয় স্মল পক্স। ১৯০০ জুড়েই চরমে ওঠে প্লেগ, প্রতিদিন তিন অংকের ঘরে পৌঁছাছিল আক্রান্তের সংখ্যা। মৃতুই হচ্ছিল রোজ। ১৯০০-এর জুলাইতে শহরে ম্যালেরিয়ার প্রদুর্ভাবও দেখা গিয়েছিল। ১৯০১ এও সংখ্যা কমেনি, প্রতিদিন গড়ে একজন করে প্লেগে মারা যাচ্ছিলেন। বিহারেও প্লেগ মারাত্মকভাবে আঘাত এনেছিল। স্বামীজির আদর্শে ভাগলপুরেও গুরুভাইরা প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াই লড়েছিলেন। ১৯০২-০৩-এ অনেক কমে আসে প্লেগ। যদিও বাংলা পুরোপুরি প্লেগমুক্ত হয়েছিল অনেক পরে, ১৯২৫ নাগাদ। ততদিনে স্বামীজি নিবেদিতা সকলেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, মহামারি চলে গেলেও শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। ১৮৯৮-এর কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্যুভয়। মৃত্যু হচ্ছিল কাতারে কাতারে। আতঙ্কিত মানুষ। প্লেগ রুখতে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে ভগিনী নিবেদিতা ও রামকৃষ্ণ মিশন লড়াই করেগিয়েছিল। প্লেগ আক্রান্ত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেবা সুস্রুশা করা, ঝাঁড়ু হাতে রাস্তায় নামা, প্লেগ রোগীকে রাত জেগে সেবা করা, তাদের সন্তানসম ভালোবাসায় সেবা দেওয়া কোন কিছুতেই কমতি রাখেননি তাঁরা। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সেবা করেছেন, এমনকি রোগীর মৃত্যুতে স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েছেন। রুখে দিয়েছেন মহামারি। মৃত্যুর অসহায়তা কাটিয়ে জীবন কথা বলেগিয়েছেন বিবেকানন্দ। আট লক্ষ কলকাতাবাসীকে জিতিয়ে দিয়ে জিতে গিয়েছিলেন আমাদের বিলে।
ধর্ম নয়, আর্তের সেবাই তাঁর জীবনদর্শন। বেদ-বেদান্ত-পুরাণে মুখ গুঁজে বা বাণী আওড়ে নয়, মাঠে নেমে লড়াই করে সেদিনের অতিমারিকে হারিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ বলা, জীবনের কথা বলা সন্ন্যাসীর কাছে আমাদের প্রাণের শহর কলকাতা কৃতজ্ঞ।
তথ্যঋণ :
১) স্বামী বিবেকানন্দের পত্রবালী (অখণ্ড)
২) স্বামীজির পদপ্রান্তে : স্বামী অব্জজানন্দ
৩) স্বামীজিকে যেই রূপ দেখিয়াছি : ভগিনী নিবেদিতা
৪) চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালি : অরুনকুমার চক্রবর্তী
৫) কলকাতার পথঘাট : প্রাণতোষ ঘটক