পুজো স্পেশাল বিভাগে ফিরে যান

বাংলার লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ টুসু পরব

January 14, 2024 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি:  টুসু পরব রাঢ়বঙ্গে একটা বিরাট অংশের মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের কাছে হৃদয়ের উৎসব। ধর্মীয় রীতিনীতির আওতার বাইরে এই উৎসবের প্রধান-অপ্রধান অঙ্গ, উপাঙ্গগুলি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এই পরবে ধর্মঠাকুর, শীতলা, মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেব-দেবীর পুজোর প্রচলন যেমন আছে, তেমনি আছে বাউলগান, কবিগান, লেটো, পঞ্চরস, ভাদ্রমাসে ভাদু আর পৌষ মাসে টুসু গান। 

পৌষে টুসু দেবীকে নিয়ে পশ্চিম বাঙলার গ্রামগুলিতে অনুষ্ঠিত হয় টুসু উৎসব। গোটা পৌষ জুড়ে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে কান পাতলে হাজারো টুসু গানের সুরেলা তরজা। তার মধ্যে রাঙামাটির দেশের সাদাসিধে মানুষের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের কাহিনি। তবে পশ্চিমা সংস্কৃতি ঝড়ে ক্রমশই জেল্লা হারাচ্ছে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার টুসু উৎসব।

টুসু পার্বণের শুরুটা কবে, কেউ জানে না। কোনও লিখিত গান নয়। প্রাচীন শ্যামা গানের মতো শুনে শুনে মনে রাখতে হয়। আর সেই ভাবেই হাজার বছরেরও বেশি বয়স হয়ে গিয়েছে টুসু গানগুলির। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টিয়েছে। প্রয়োজনে নতুন টুসু গান তৈরিও হয়েছে অনেক।

এভাবেই রাঢ় বাংলার জীবন জীবিকা, সুখ দুঃখ হাসি, কান্না, লড়াই আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সাথি ছিল টুসু গান। বাউরি- বাগদি-ভূমিজ এই সব গরিব মানুষের কাছে টুসু গান ছিল বিনোদনের উপাদান।

বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলির গ্রামাঞ্চলে টুসু পুজো প্রচলিত। ঝাড়খণ্ডের সিংভূমেও পূজিত হন এই লোকদেবী। লোকগবেষকদের মতে, বাঁকুড়ারা পরকুল, পরেশনাথ, কেচন্দা, লক্ষ্মীসাগর, বীরপাট, সুইসা ও মানবাজারের সিন্ত্রীর টুসুমেলা বহু বছরের প্রাচীন। ও পার বাংলার রাজশাহীতে রাজোয়ারদের মধ্যেও টুসু পরবের চল আছে।

টুসু নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি, ধানের তুষ, শীতের সময় যা জ্বালিয়ে আমাদের গ্রামেগঞ্জে লোকেরা আঁচ পোহায়, সেই তুষ থেকেই টুসু নামটি এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত পৌষালি উৎসব ‘তুষতুষালি ব্রতকথা’র মধ্যে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। টুসু দ্রাবিড় অস্ট্রিক ভাষাবর্গের কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবী বলে প্রচলিত। তুষ দিয়েই পূজার ডালি সাজানো হয়। বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা ঊষা থেকে টুসু শব্দটি এসেছে, আবার মধ্যপ্রাচ্যের প্রজননের দেবতা টেষুব থেকে টুসু শব্দটি তৈরি হয়েছে বলেও মত আছে।

অগ্রহায়ণের শেষ দিন থেকে পৌষের শেষ দিন অবধি রাঢ় বাংলার গ্রামে গ্রামে এই টুসু পূজিত হন। গ্রামের একান্নবর্তী পরিবারের মেয়েরা বা দু-চারটি ছোট ছোট পরিবারের মেয়েরা একসাথে জড়ো হয়ে প্রতি সন্ধ্যায় শুরু করে টুসু আরাধনা। এ দিন মাঠ থেকে নতুন ধানের একটা গোছা মাথায় করে আনেন পাড়ার মেয়েরা। কুমোরদের বিশেষ কায়দায় তৈরি পোড়া মাটির খোলায় ধানের তুষ দিয়ে তার উপর গাঁদাফুল সাজিয়ে তৈরি করা হয় টুসুখোলা। সন্ধ্যা হলে অবিবাহিত মেয়েদের দল তুষের উপরে রাখে আলো-চাল, দূর্বাঘাস, সর্ষে, বাসক, আকন্দের মতো ফুল। তার পরে পাত্রটিকে হলুদ টিপ পরিয়ে পিঁড়ির উপরে বসিয়ে বাড়ির উঠোনে রেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে তার চারদিকে বসে শুরু হয় গানের ঐক্যতান। 

দেবীর উদ্দেশে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন। পাড়ার অবিবাহিত মেয়েরা সন্ধ্যায় এক সঙ্গে টুসু গান গেয়ে তাঁদের সুখ দুঃখের কথা বলে। যোগ দেয় বাড়ির কচিকাঁচা থেকে বয়স্কা মহিলারাও। পৌষের শেষ চার দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই চার দিনের প্রথম দিনকে বলা হয়ে থাকে চাউড়ি। এ দিন বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় চালগুড়ি। বাড়ির মেয়েরা গোবর মাটি দিয়ে উঠোন নিকোন। দ্বিতীয় দিন বাউড়ি। সে দিন তৈরি হয় নানা আকারের, নানা পিঠে। রাত জাগতে হয়। সব বাড়ি আলোয় সেজে ওঠে।

এক মাস ধরে এই মন্ত্রহীন পূজার শেষে পৌষসংক্রান্তির ভোরে টুসুদেবীকে সুসজ্জিত চতুর্দোলায় বসিয়ে গান গাইতে গাইতে নিয়ে গিয়ে কাছের নদী, দিঘি বা পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপরে স্নান করে, নতুন কাপড় পরে, মেয়েরা গান গাইতে গাইতে ফিরে যায় গ্রামে। এ সময়ে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের মধ্যে গানের লড়াই চলে। ‘আমার টুসু নেয়ে এল/ কী বা পরতে দিব গো?/ ঘরে আছে বেনারসী/ সেটি বার করে দিব গো।/ ওদের টুসু নেয়ে এল/ ওরা কী বা পরতে দিবে গো?/ ওদের ঘরে আছে ছিঁড়া ট্যানা / ওরা তাই বার করে দিবে গো’। টুসু বিসর্জনকে কেন্দ্র করে বহু জায়গায় বসে মেলা।

ঝাড়খণ্ড ও পুরুলিয়ায় অধিকাংশ স্থানে টুসু মূর্তির প্রচলন নেই, কিন্তু পুরুলিয়ার বান্দোয়ান এবং বাঁকুড়ার খাতড়ার পোরকুলে টুসু মূর্তির চল আছে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে অশ্ব বাহিনী বা ময়ূর বাহিনী মূর্তিগুলির রং হলুদ ও শাড়ির রং নীল। হাতে কখনও শঙ্খ, কখনও পদ্ম, কখনও পাতা বা বরাভয় মুদ্রা দেখা যায়।

১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের কাছ থেকে জনমত সংগ্রহ করা শুরু করে। মানভূমের মানুষের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য, টুসুগানের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য।

কালে কালে টুসু উৎসবের পুরনো গৌরব হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু আজও মকর সংক্রান্তিতে গ্রামের মেঠো পথে সর্ষে ক্ষেতের ওপার থেকে টুসু গানের সুর শোনা যায়, মনে হয়, না, রাঢ়বঙ্গ এখনও তার বৈশিষ্ট্যকে হারিয়ে যেতে দেয়নি।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #Tusu Festival

আরো দেখুন