হাঁদা-ভোঁদা থেকে নন্টে-ফন্টে, চিনে নিন নারায়ণী সেনাদের
নারায়ণ দেবনাথ বাংলা কমিকসের জগতে এসেছিলেন দেব সাহিত্য কুটিরের হাত ধরে। সে’সময় বাংলা ভাষার কমিকস বলতে ছিল প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ’র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা যুগান্তরে প্রকাশিত হত। প্রায় ছয় দশক ধরে নিজের হাতের জাদুস্পর্শে বাঙালির ছোটবেলাকে গড়েপিঠে নিয়েছেন কমিকের মুকুটহীন সম্রাট নারায়ণ দেবনাথ।
যাদের সঙ্গে নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন নারায়ণ দেবনাথ :
১) হাঁদা ভোঁদা :
১৯৬২ সালে শুকতারার পাতায় হাঁদা এবং ভোঁদার আবির্ভাব হয়। হাঁদারাম গড়গড়ি আর ভোঁদারাম পাকড়াশী নামের দুই দুষ্টু ছেলের কান্ডকারখানা। হাঁদা রোগা আর ভোঁদা মোটা। সবসময় একজন অন্যজনেকে, জব্দ করার ফন্দি আঁটে কিন্তু শেষে প্রায়ই হাঁদা জব্দ হয়। তাদের দুষ্টুমিতে প্রাঞ্জল হয়ে উঠল কমিক্সের পাতা। এই দুই চরিত্রকে আপন করে নেয় বাঙালি। হাঁদা ভোঁদা শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৬২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ৫৫ বছর নারায়ণ দেবনাথঃ নিয়মিত হাঁদা ভোঁদা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে একজন একক লেখক এবং শিল্পীর করা সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা কমিক সিরিজ।
২) শুটকি মুটকি :
শুকতারায় হাঁদা ভোঁদা বেরোনোর পরে, কিশোর ভারতী পত্রিকার অনুরোধে দুই দস্যি মেয়েকে নিয়ে আসেন নারায়ণ দেবনাথ। নতুন জুটির নাম দিলেন শুটকি মুটকি। ১৯৬৪ তা প্রকাশিত হল, এই প্রথমবারের জন্য দুই নারী চরিত্রকে ভর করে তৈরি হল বাংলা কমিক। ইতিহাস তৈরি করলেন নারায়ণ বাবু।
৩) বাঁটুল দি গ্রেট :
১৯৬৫ সাল থেকে নারায়ণ বাবুর হাত ধরে বাংলা কমিকের একমাত্র অতিমানব বাঁটুল দি গ্রেট পথ চলা শুরু করে। নারায়ণ দেবনাথের প্রথম রঙিন কমিক স্ট্রিপ ছিল এটি। তাঁর নিজের কথায়, একদিন কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তাঁর মাথায় বাঁটুলের ভাবনা আসে। তৎক্ষণাৎ এঁকে ফেললেন গোলাপী স্যান্ডো গেঞ্জি, কালো হাফ প্যান্ট, খালি পায়ে, বাঁটুল দি গ্রেট, তার সঙ্গীরাও বিচিত্র দুই ভাগ্নে ভজা, গজা, পটলা, লম্বকর্ণ, পোষা কুকুর ভেদো আর পোষা উটপাখি উটো। বাঁটুল দেশপ্রেমিক। একদিকে সে ভারতের জন্য অলিম্পিকে মেডেল আনছে। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধে কখনও সে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে, কখনও যুদ্ধবিমানের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে, আবার ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিচ্ছে। বাঁটুল হয়ে গেল বাঙালির সুপারহিরো। যদিও প্রথমটায় বাঁটুলকে কোন অলৌকিক শক্তি দেননি স্রষ্টা। ২০১২ সালে বাঁটুল প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।
৪) নন্টে ফন্টে :
নারায়ণ দেবনাথের অন্যতম জনপ্রিয় কমিকস স্ট্রিপ সিরিজ হল নন্টে ফন্টে। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে কিশোরভারতী পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় নন্টে ফন্টে-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। হাঁদা এবং ভোঁদার আদলেই নন্টে এবং ফন্টেকে গড়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।
১৯৭২ সালে মনোরঞ্জন ঘোষের লেখা পরিবর্তন বইটির পুনর্মুদ্রণের জন্য বইটির অলংকরণ করার সময়ে তিনি সেখানে কয়েকটি ছেলের হোস্টেল জীবনের গল্প পড়েন। এরপরেই তাঁর কমিক নন্টে ফন্টেতেও হোস্টেলের গল্প শুরু হয়। নারায়ণ বাবু তৈরি করতেন থাকেন একের পর এক সিরিজ। বোডিং-এর পেটুক সুপারিনটেনডেন্ট স্যার হাতিরাম পাতি, দুষ্টু ছাত্র নন্টে ফন্টেদের সিনিয়র কেল্টুরামের মতো চরিত্ররা একে একে এসে পড়েন গল্পে, স্রষ্টা ও সৃষ্টি দুই অমর হয়ে যায়।
নন্টে আর ফন্টে হরিহর আত্মা, স্কুলের সহপাঠী দুজনেই বোডিং স্কুলের হোস্টেলে থাকে। নন্টে-ফন্টের হোস্টেল জীবন যেন এক রূপকথা। এই হোস্টেল জীবনই মিষ্টি কৈশোরের নস্টালজিয়া।
৫) ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ:
কিশোর ভারতীর পাতায় ১৯৬৯ সালে ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পটলচাঁদ হলেন এক জাদুকর, যে তার জাদু দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করে।
৬) ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায় :
কিশোর ভারতীর সম্পাদক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারায়নবাবুকে গোয়েন্দা গল্পের কমিক স্ট্রিপ তৈরি করার প্রস্তাব দেন। ১৯৭০ সালে হাসি-মজা আর অ্যাডভেঞ্চারের মিশেলে দিলীপ চট্টপাধ্যায়ের লেখা থেকে নারায়ণ দেবনাথ ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায় সৃষ্টি করেন। বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পের কমিক স্ট্রিপের পুরোধা এটি। সেই অর্থে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা গ্রাফিক নভেল ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়। ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়ের সর্বমোট নয়টি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল।
৭) বাহাদুর বেড়াল :
১৯৮২ সালে নারায়ণ নিয়ে আসলেন বাহাদুর বেড়াল। এই কমিকের নায়ক একটি বিড়াল। সে অদ্ভুত, ধুরন্ধর বুদ্ধিমান প্রাণী কিন্তু এতো বুদ্ধি মাঝে মাজে তার নিজের বিপদ ডেকে আনে। দম ফাটা হাসির এই সিরিজ প্রশ্নতীত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
৮) কৌশিক রায় :
১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ শুকতারার পাতায় যাত্রা শুরু করে গোয়েন্দা কৌশিক রায়। সর্পরাজ্যের রাজা গল্পের মাধ্যমে কৌশিক রায়ের আবির্ভাব ঘটে। ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীতে কর্মরত একজন সিক্রেট এজেন্ট ছিলেন কৌশিক রায়। সে মার্শেল আর্টে সিদ্ধহস্ত। কৌশিক রায়ের ডান হাত ছিল ইস্পাতের যা দিয়ে গোয়েন্দা রায় বুলেট, ফায়ার লেসার, স্লিপিং গ্যাস চালনা করত। কৌশিক রায়কে নিয়ে তিনি সর্বমোট ১৪ টি গল্প লিখেছিলেন।
৯) ডানপিটে খাদু আর কেমিক্যাল দাদু :
মর্টি ও রিকের ছায়া পাওয়া যায় এই চরিত্রে, ১৯৮৩ সালে শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের হাত এদের জন্ম দেয়।
১০) পেটুকমাস্টার বটুকলাল :
১৯৮৪ নারায়ণ দেবনাথ নিয়ে আসলেন পেটুকমাস্টার বটুকলাল চরিত্রটি, বটুকলাল একজন স্কুল শিক্ষক। সে ভোজন রসিক, সুযোগ পেলেই সে খাবার চুরি করে খায়। কিন্তু তার ছাত্ররা শোনা বারবার ধরে ফেলে ফলে খাবার চুরির চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
আবালবৃদ্ধনিতার ঘরের লোক, মুখের হাসি হয়ে উঠেছিল এই চরিত্রগুলো। চরিত্রগুলির সারল্যমাখা কাণ্ডকারখানা শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলিকে রঙিন করে তুলেছিল। হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা, সবার অজান্তেই এদের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে ছিলেন বনস্পতি, আজ সেই বনস্পতি পড়েগেলেন। বাসা করা পাখিরা উড়ে গেল। শিকড়ের তো যন্ত্রনা হয়। বাঙালি আজ সেই শিকড়ের টানটা বড্ড অনুভব করছে। নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা, কেল্টুদের সঙ্গে কোনদিন আর আমাদের দেখা হবে না। সৃষ্টিদের নিয়ে ওপারেই ভাল থাকুন স্রষ্টা।