বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

শুধুই মহর্ষি কিংবা রবির পিতা নন, জানেন দেবেন্দ্রনাথের কী পরিচয়?

January 19, 2024 | 2 min read

নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: উনিশ শতকে কলমের জাদুতে যে কাহিনি গড়ে উঠেছিল তাঁর অন্যতম কান্ডারী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি শুধুই মহর্ষি কিংবা রবির পিতা নন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাণিক্যখচিত জুতোজোড়া, সরস্বতী পুজোর কেনাকাটি, গন্ধবিলাস,  দামী মসলিন দিয়ে গা মোছার গল্পেই তো একসময়ে গড়ে উঠেছিল এ শহরের রূপকথা। 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ( Debendranath Tagore ) এর জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৫ মে, ১৮১৭ সালে। তার পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মাতা দিগম্বরী দেবী। ধনীর ঘরের দুলাল হিসেবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রথম জীবন নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত করেন। 

১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পিতামহী অলকা দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনধারা আমুল পরিবর্তন আসে। এই সময় উপনিষদের তত্ত্ব তাকে গভীর ভাবে অনুপ্রানিত করে।উপনিষদেরএকটি শ্লোক  তাঁকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করেছিল সেই সময়। 

“ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ,তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জী মা গৃধঃ কস্যসিবধ্বনং।”

যদিও এর মানে প্রাথমিক ভাবে দেবেন্দ্রনাথের কাছে ছিল অস্পষ্ট। তারপর ব্রাহ্ম সমাজের রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের কাছে জানতে পারেন এর মর্মার্থ – যে,এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যেখানে যা কিছু রয়েছে তা সবই পরমেশ্বর দ্বারা ব্যাপ্ত- পাপ চিন্তা ও বিষয়ের প্রতি লোভ ত্যাগ করে ব্রহ্মের আনন্দ উপভোগ করতে হবে,অন্য কারও ধনে লোভ করা অনুচিত ।

এই শ্লোকের মধ্যেই তিনি প্রথম পেয়েছিলেন বিশ্বপ্রেমের সন্ধান। আর তারপরেই সব বিলাসব্যসন মুছে গিয়েছিল তাঁর জীবন থেকে।

মূলতঃ উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ স্থাপন করেন। পরে তার নাম হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’। পরবর্তী কালে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহন করেন এবং এই ধর্ম প্রসারে উদ্দ্যোগী হন।

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ বোলপুরে জমি কিনেছিলেন।  দেবেন্দ্রনাথ বীরভূমের প্রভাবশালী জমিদার রায়পুরের সিনহাদের বাড়িতে যেতেন মাঝে মাঝেই। এ রকম এক সফরে মহর্ষি যখন বোলপুর হয়ে রায়পুরে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বিস্তৃত এলাকাজুড়ে আমের বাগান ও জঙ্গল দেখতে পান। এ স্থানটি তখন ‘ভুবনডাঙার মাঠ’ নামে পরিচিত ছিল এবং এখনো তা-ই আছে। সে আমলে অঞ্চলটি ডাকাত ও খুনিদের আস্তানা ছিল। সাধারণ মানুষ দিনের বেলায় এ জায়গা পার হতে ভয় পেত। 

স্থানটির বিশালতা মহর্ষির মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে। বিশেষত একটি ছাতিম গাছ। মহর্ষি তার লটবহরকে থামতে নির্দেশ দেন এবং ছাতিম গাছের তলায় ধ্যানে বসেন। এটা তার মনে প্রশান্তি আনে। জায়গাটি তার খুব পছন্দ হয় এবং ঠিক সেখানে বসে তখনই তিনি এখানে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। জমির মালিক ছিলেন রায়পুরের সিনহারা। তাদের কাছ থেকেই মহর্ষি ২০ বিঘা জমি কিনেছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ পূজা-পার্বণাদি বন্ধ করে ‘মাঘ উৎসব’, ‘নববর্ষ’, ‘দীক্ষা দিন’ ইত্যাদি উৎসব প্রবর্তন করেন। এছাড়াও তিনি হিন্দু চ্যারিট্যাবল ইনস্টিটিউশনের বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পৌত্তলিকতা ছেড়ে ব্রহ্ম হয়ে যাওয়ায় পূজা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন। 

নারী শিক্ষায় বিশেষ আগ্রহ ছিল দেবেন্দ্রনাথের। সৌদামিনীকে মিশনারি মেয়েদের কাছে পাঠিয়েছেন; বেথুন স্কুল স্থাপিত হওয়ার পর যখন ছাত্রী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে তিনি সৌদামিনী ও তার খুড়তুতো বোনকে সেখানে পড়তে পাঠিয়ে  দেন। বাড়ির মেয়েদের সে সময় খোলা ছাদে যাওয়া নিষিদ্ধ  ছিল। তিনি সে ছাদ উন্মুক্ত করে দিলেন। 

দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তাঁর বহু ঋণ দেবেন্দ্রনাথের কাঁধে এসে পড়ে।  ১৮৫৯ সালে তিনি কলকাতায় ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পর ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম কেশবচন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত করেন। পরে ধর্মীয় আদর্শের কারণে কেশবচন্দ্রের সাথে সংঘাত উপস্থিত হলে – ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী ধর্মের নাম ছিল ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’, পক্ষান্তরে দেবেন্দ্রনাথের অনুগামী ধর্মের নাম হলো – ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। এরপর ধীরে ধীরে তিনি সকল বৈষয়িক ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।

১৯ জানুয়ারি, ১৯০৫ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়। দেবেন্দ্রনাথ সত্যিই কি আচারে কি মানসিকতায় সেই যুগের আধুনিকতম পুরোধাপুরুষ ছিলেন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Debendranath Tagore, #Tagore family

আরো দেখুন