মানবেন্দ্রর পরীক্ষা নিয়েছিলেন তারাশঙ্কর!
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’,‘তমি ফিরায়ে দিয়েছ বলে’, ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ প্রভৃতি গানের কণ্ঠশিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩০ সালের ১১ আগস্ট। আর মৃত্যু ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি। পিতার নাম অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাদের আদি বাড়ি ছিল বরিশালের উজিরপুরে। তারা ছিলেন তিন ভাই এক বোন। মানবেন্দ্র সবার বড়। ১৯৫৫ সালের ৮ মে মানবেন্দ্রের সঙ্গে বেলা দেবীর বিয়ে হয়। তার শেষ জীবন কেটেছে কলকাতার যাদবপুর এলাকায়।
রাগপ্রধান বাংলাগান এবং নজরুলসঙ্গীতের জন্যই শুধু তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাঙালি শ্রোতা তাকে মনে রাখবে বহু চলচ্চিত্রে তার অনন্যসাধারণ সুর সৃষ্টির জন্যেও। জন্ম কালীঘাটে হলেও বড় হওয়া টালিগঞ্জের ভবানী সিনেমার পাশের গলিতে, বাঙাল পাড়ায়, যৌথ পরিবারে। ছিলেন খাঁটি ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক। লাল-হলুদ জিতলেই বড় একটা ইলিশ কিনে বাড়ি ঢুকতেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক গল্প রয়েছে বাংলার সঙ্গীত মহলে। যেমন-
‘‘আপনাকে একটু খারাপ করে গাইতে হবে।’’
স্বয়ং ছবির পরিচালকের এমন কথায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
‘দেয়া নেয়া’ ছবির গান। ‘দোলে দো দুল দোলে ঝুলনা’। তারই রেকর্ডিং-এর আগে রিহার্সাল।
সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র আছেন। ইউনিটের অন্যরাও উপস্থিত। তারই ফাঁকে অমন বজ্রপাত।
‘‘মানে! কেন? কী বলছেন আপনি!’’
পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আসলে ছবিতে নায়ক (উত্তমকুমার) গান জানেন। তাঁর বন্ধু (তরুণকুমার) গাইতে পারেন না। গল্পে এমনই বলা আছে। নায়কের গানটা শ্যামলবাবুর (মিত্র)। আপনি গাইছেন বন্ধুর লিপে।’’
‘‘তা বলে খারাপ করে গাইতে হবে! তা হলে আমাকে ডেকেছেন কেন? আমায় বরং ছেড়ে দিন।’’
গম্ভীর হয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন মানবেন্দ্র। তখনই নায়ক উত্তমকুমারের প্রবেশ। কনট্রোল রুমে বসেছিলেন এতক্ষণ। এ ঘরের সব কথাই তাঁর কানে গেছে। ঢুকেই বললেন, ‘‘মানব, তুই উঠিস না।’’
মানবেন্দ্রর মনের অবস্থাটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি। আলাপ তো আর এক দিনের নয়। যখন তিনি চলচ্চিত্রেরই ধারেকাছে নেই, তখন থেকেই। টালিগঞ্জের বাঙাল পাড়ায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে তবলা শিখতে যেতেন সে দিনের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। সে কত কাল আগে! সেই আলাপ আরওই জমে গিয়েছিল ‘সাড়ে ৭৪’-এ একসঙ্গে অভিনয় করায়।
তখন ‘চাঁপাডাঙার বউ’ সিনেমা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন পরিচালক নির্মল দে। তিনি মানবেন্দ্রকে দায়িত্ব দিলেন সঙ্গীত পরিচালনার। সেকথা শুনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘আমার ছবিতে কে সুর দিচ্ছে, তাকে আগে একটু দেখতে চাই। তার গানের একটু পরীক্ষা নিই, তবে রাজি হব।’
তারাশঙ্করের টালার বাড়িতে পরিচালক নিয়ে গেলেন মানবেন্দ্রকে। তাঁকে দেখে ভরসা পেলেন না তারাশঙ্কর। তিনি পরিচালককে বললেন, ‘না, মনে হচ্ছে একে দিয়ে হবে না। তুমি একটা পাকা সঙ্গীত পরিচালকের খোঁজ কর।’ অবশ্য একটু পরে কী মনে হল, একটা গানের দু’টো লাইন লিখে দিয়ে মানবেন্দ্রকে বললেন, ‘একটু সুর করে দেখাও তো। এটা গাজনে শিবের নৃত্য। ছবিতে উত্তমকুমার গাইবেন।’ একটু ভেবে মনে মনে সুর করে মানবেন্দ্র গেয়ে উঠলেন। ঢাকের তালে তাল মেলানো সেই সুর একেবারে গাজনের ছন্দের সঙ্গে মিলে যায়। গান শুনে খুশি হলেন তারাশঙ্কর। বললেন, ‘না হে নির্মল। একে দিয়েই হবে।’