যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের লেখনী ছিল উনিশ শতকের সমাজদর্পণ
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: গুপ্তকবি ঈশ্বর গুপ্ত, তাঁর ছড়ার ছন্দে বেঁধে রেখে গিয়েছেন সমসাময়িক সময়কে। তাঁর লেখার উঠে এসেছে সমাজের প্রতিচ্চবি। তিনি কবি আবার তারকা সাংবাদিক। তবে কেউ কেউ তাঁকে পুরোপুরি কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। বিদগ্ধজনেরা স্বীকৃতি দিতে চান না; আদপে তিনি সমাজ পর্যবেক্ষক। নানান ঘটনার প্রতি তাঁর নজর থাকে। সামাজিক আব্রু তিনি খুলে ফেলতে ভালবাসেন। সত্যিকে সত্যি আর মিথ্যেকে মিথ্যে বলতে তিনি সিদ্ধহস্ত। ভরতচন্দ্র, হরু ঠাকুর, রামপ্রসাদদের জীবনী লেখেন তিনি। তাঁর লেখার অগ্রজদের ছাপ স্পষ্ট। রায়গুণাকর আর রঙ্গলালদের মধ্যে থাকা সেতুই গুপ্তকবি। উনিশ শতকের বাংলার আর্থ-সামাজিক ইতিহাস বা সাহিত্য কারও স্পর্দা নেই তাঁকে অস্বীকার করার।
বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র খুব গুরুত্বপূর্ণ কবি নন কিন্তু বাংলা কবিতার পথ বিনির্মাণে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উনিশশতকের তৃতীয় দশক থেকে পঞ্চমদশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য কেবল ঈশ্বরগুপ্তময়; সাহিত্য সমাজে তাঁর প্রভাব ছিল অভাবনীয়। তিনি খুলে দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের হৃদয়-কপাট। বাংলা ভাষার সংবাদপত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তিনি প্রধানত কবি। বিস্মৃতির অতল তলে তাঁর আর সকল কর্মযজ্ঞ হারিয়ে গেলেও বাংলা কবিতার বিশেষ অলংকৃত সিংহাসনটি কখনও হারাবার নয়।
কর্মজীবনে ঈশ্বরগুপ্ত একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তৎকালে তাঁর কবিতার যথেষ্ট সমাদর ছিল। সংবাদপত্রের কাটতির জন্য তিনি বাধ্য হয়ে অনেক কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিপ্রতিভাটাই ছিল সাংবাদিক ঘরানার। সাময়িকতাই সে-সকল কবিতার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। সমাজের সত্যিকারের রূপ তিনি তুলে ধরেছেন অকপটে।
‘সংবাদ প্রভাকরে’র মারফতে তিনি এ যুগের সমগ্র বাঙালির মনে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। কলকাতার অভিজাত ব্যক্তিরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, ইংরেজ শাসকও তাঁর পত্রিকার ও মতামতের মূল্য দিতেন। পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর বিশেষ না থাকলেও জীবনের ব্যবহারিক ও বাস্তবক্ষেত্রে তাঁর সাধারণ জ্ঞান খুব তীক্ষ্ম ছিল।
ঈশ্বরগুপ্ত মূলত বাস্তবতার কবি; দিনের আলোর কবি; আলো-আঁধারির কবি নন। সামাজিক অসামঞ্জস্যগুলোকে তিনি রঙ্গব্যঙ্গের মধ্যদিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কবিতায় আবেগের স্থান নেই; নিরাবেগই সেখানে প্রাণশক্তি। প্রেম তাঁর কাছে হাস্যকর শিরপীড়া ছাড়া আর কিছু নয়।
নারীর প্রেমে তাঁর নীরাসক্তি থাকলেও স্বদেশপ্রেমের কবিতায় কিন্তু তিনি ঠিকই শতভাগ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তৎকালে জনসাধারণ ঈশ্বরগুপ্তের স্বদেশপ্রেমের কবিতা পাঠ করে অনুপ্রেরণা পেত। তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষার অন্য কোনো কবি এমন সুতীব্র দেশপ্রেমের কবিতা লিখে যেতে পারেননি।