বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

সম্প্রীতি ও সাম্যবাদ – নেতাজির দুই মন্ত্র

January 23, 2024 | 3 min read

২১ জানুয়ারি, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আগে, এলগিন রোডের নেতাজি ভবনে হাজির হয়েছিলাম। সে কী সাজো সাজো রব! উপলক্ষটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। আজ, ২৩ জানুয়ারি, শিশিরকুমার বসুর ব্রোঞ্জমুর্তির উদ্বোধন। তারই প্রস্তুতি চলছিল সেদিন।

একটা ব্যাপারে অবাক হয়েছিলাম, ভালও লেগেছিল। দু’দিন আগে থেকেই কত মুখের ভিড় নেতাজি ভবনের আঙিনায়। বাচ্চার হাত ধরে অভিভাবকরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ও বোঝাচ্ছেন নেতাজি-মাহাত্ব্য। কেউ সেলফি তুলছেন, চাইছেন ফোটোগ্রাফের সুবাদে বিরাট ইতিহাসের চলমান অংশ হয়ে যেতে। অনেকেই লাইব্রেরিতে ঘুরছেন। একজন তো এসেছেন সুদূর বাংলাদেশ থেকে । উদ্দেশ্য, চিকিৎসা করানো। কিন্তু হাতে কিছু বাড়তি সময় থাকায় সটান নেতাজি ভবনে হাজির। সুভাষচন্দ্র বসুর ইংরেজি বক্তৃতার বাংলা সংকলন আছে কি? এই তাঁর জিজ্ঞাস্য।

এই মুখর আবহে-ই পাওয়া গেল অধ্যাপক সুগত বসুকে। হাসিমুখে জানালেন, ব্যস্ততা তুঙ্গে। দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না। কিন্তু কথায়, আলোচনায় ধার্য সময় কখন যে পেরিয়ে গেল! উদ্ভাসিত হল বহুমুখী বাস্তবের আলো। যেসব বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশিষ্ট অধ্যাপক, তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হল:

গুজব, ‘রহস্যমানব’ ও নেতাজি

নেতাজি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্যের কথা যদি আমরা ভাবি, তাহলে পরিষ্কার করে বলা যায় যে, বিশ শতকের পাঁচের দশক থেকে নেতাজি সংক্রান্ত যেসব দলিল-যেমন তাঁর আলোকচিত্র ও ফিল্ম ফুটেজ, তাঁর কন্ঠস্বর, তাঁর লেখা চিঠি- যা কিছু তিলে তিলে সংগ্রহ করা হয়েছে- সেগুলোই নেতাজি সম্বন্ধে সবচেয়ে বিশ্বাস্য তথ্য। সেগুলিই পড়া উচিত। বারবার পড়া উচিত। আমার বাবা শিশিরকুমার বসু বলতেন, নেতাজি ‘রহস্যমানব’ ছিলেন না। তাঁর জীবন ছিল একদম কাচের মতো পরিষ্কার, স্বচ্ছ। কিন্তু তাঁকে বারবার রহস্যমানব করে তোলার অপচেষ্টা হয়েছে। ‘নেতাজি’ ও ‘রহস্য’ এই দু’টি শব্দকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সচেতনভাবে। এমন অবস্থায় নেতাজির নিজের লেখাপত্র পড়তে হবে গভীর মনোযোগে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি জড়িত ছিলেন, এ কথা সুবিদিত। কিন্তু আজাদ হিন্দুস্তানের বিষয়ে তিনি বস্তুত কী চিন্তা পোষণ করতেন, তা তরুণ প্রজন্ম তখনই জানতে পারবে, যখন তাঁকে পুনঃপাঠে আগ্রহী হবে।

“ইনক্লুসিভ ইন্ডিয়া” ও নেতাজি

আজীবন সুভাষচন্দ্র বসু দু’টি বিষয়কে ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছেন। এক)সাম্য। দুই)সমানাধিকার। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক যেন সাম্য ও সমানাধিকার চর্চার সুযোগ পায়। তিনি কখনওই বলেননি, একে-অন্যকে সহ্য করতে হবে। বরং বলেছেন ‘কালচারাল ইন্টিমেসি’ বা ‘সাংস্কৃতিক সান্নিধ্য’-র কথা। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি নাগরিককে অন্তর দিয়ে চিনতে হবে তাঁর সহ-নাগরিককে। একে-অপরকে ভালবাসতে হবে। আমরা যদি তার আজাদ হিন্দ সরকারের প্রক্লেমেশনটি পড়ে দেখি, দেখব, শেষ বাক্যে ‘ইক্যুয়াল রাইটস’ বা সমানাধিকারের কথা তিন-তিনবার জোর গলায় বলেছেন।

আর, তাঁর জীবন যদি দেখি, তাহলেও শিক্ষণীয় উপকরণ পাব বইকি। আমার বাবা শিশিরকুমার বসু এই বাড়ি থেকে তাঁকে মোটরে করে নিয়ে গেলেন গোমো অবধি।কিন্তু পেশায়ারে কে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর জন্য? মিয়া আকবর শা। যিনি দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের স্বাধীনতা সংগ্রামী। নেতাজি যখন ৯০ দিন ধরে ডুবোজাহাজে করে ইউরোপ থেকে এশিয়া এলেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ, সেই সময় প্রথম কয়েক মাস তাঁর একমাত্র ভারতীয় সঙ্গীর নাম ছিল আবিদ হাসান।যখন আজাদ হিন্দ বাহিনী যুদ্ধ করল কোহিমায়, ফৌজের প্রথম ডিভিশনের সেনাপতির নাম ছিল মহম্মদ জামান কিয়ানি।

সম্প্রতি মইরাং গিয়েছিলাম। এই মইরাংয়ে ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে যিনি প্রথম তেরঙা উড়িয়েছিলেন, সেই সেনাধ্যক্ষের নাম ছিল শওকত মালিক। আর, নেতাজির শেষ বিমানযাত্রায় একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী ছিলেন হাবিবুর রহমান। আর, যখন স্থির হল যে আজাদ হিন্দ ফৌজের একটা স্মৃতিস্তস্ত গড়তে হবে সিঙ্গাপুরে, তখন যাঁকে এটি তৈরি করার ভার দিয়েছিলেন নেতাজি- তাঁর নাম কর্নেল সিরিল জন স্টরসি। চুম্বকে, প্রত্যেককে নিয়ে চলার এই যে আদর্শ, যাকে আমরা ইনক্লুসিভনেস বলি, তা নেতাজি কাজে করে দেখিয়েছিলেন।

‘জাতীয়তাবাদ’ ও নেতাজি

নেতাজি যে দেশপ্রেমের কথা বলতেন, সেটা ছিল ভীষণ উদার। ‘দেশপ্রেম’ বলতে তিনি বুঝতেন সেই ভালবাসা, যা আমাদের উৎসাহিত করবে একে-অপরকে সেবা করতে। একই সঙ্গে যে দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করবে সৃজনশীল হতে। যে জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ, আত্মমগ্ন ও স্বার্থপরতার দোষে দুষ্ট আর ঔদ্ধত্যে পরিপূর্ণ-তাকে তিনি কখনও স্বীকৃতি দেননি।

তিনি জানতেন দেশপ্রেমের দুটো দিক থাকতে পারে। একটা দিক থেকে আমরা পেতে পারি উন্নতির আলো। আর একটা দিক থেকে আমরা পেতে পারি বিভেদ ও কলহের বার্তা।

অনেকেই নেতাজিকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলেন। তাঁরা নিশ্চয় ঠিক বলেন। তবে এর সঙ্গে আরও দুটো কথা যোগ করতে হবে। তা হল: নেতাজি ঐক্য ও সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন।

“হিজ ম্যাজেস্টি’স অপোনেন্ট” ও নেতাজি

আমার এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালে। সেটি যা ও যেমন ছিল, সেই আকারেই আবারও প্রকাশিত হচ্ছে। তবে আমাকে বলা হয়েছিল নতুন একটি ‘ইন্ট্রোডাকশন’ বা ‘ভূমিকা’ লিখতে। ২০১১-‘২০। মাঝের এই ক’বছরে বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি সাংঘাতিকভাবে বদলেছে ও প্রভাবিত হয়েছে। উত্থান ঘটেছে সেই দক্ষিণপন্থী শক্তির, যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত তো বটে, কিন্তু স্বভাবে ও প্রকরণে খুবই স্বৈরাচারী। এটা সারা পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, তুরস্ক এমনকী এই ভারতেও তার দেখা মিলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নেতাজির জীবনদর্শন কীভাবে নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নিয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়েছে। ভূমিকায় সেটাই তুলে ধরেছি।

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নেতাজির গভীর নৈকট্য ছিল। সেটা আমি আরও জোর দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছি। কারণ, অনেক সময়ই একটা ভ্রান্তি আমরা দেখতে পাই যে এঁদের দু’জনকে দুই মেরুতে রেখে বিভাজনের রাজনীতি চলছে। ১৯৩৯ সালে এঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একটা মতাদর্শগত ভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা বিশেষ স্থায়ী হয়নি। ১৯৪২ সাল থেকে আমরা দেখি এঁরা পরস্পর সম্বন্ধে যে-কথা বলছেন, তাতে শ্রদ্ধার এতটুকু অভাব নেই। আমরা কী করে ভুলতে পারি, ১৯২১ থেকে পরের প্রায় দু’-দশক সুভাষচন্দ্র বসু দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন গান্ধীজির নেতৃত্ব শিরোধার্য করেই।

লেখনী: সুগত বসু (প্রবন্ধটি সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Netaji Subhas Chandra Bose

আরো দেখুন