বনবিনি: সুন্দরবনের রক্ষাকর্ত্রী, হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির দেবী
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: লোকায়ত বাংলার অন্যতম দেবী বনবিবি। সুন্দরবনে পূজিত হন বনবিবি। শোনা যায়, বনবিবিই দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে রক্ষা করেন গ্ৰামবাসীদের। লোককথায় পাওয়া যায় বনবিবির কথা, আদপে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দেবী। বাদাবনে পদে পদে ঝুঁকি। জীবন, জীবিকার জন্য এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করে। নদী, ঘূর্ণিঝড়, হিংস্র বাঘ, কুমির সব্বার সঙ্গেই সুন্দরবনের মানুষদের লড়াই। ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বাভাবিক উপায় গুলি যখন ব্যর্থ হয়, তখনই পরিত্রাণ পেতে মানুষ আশ্রয় নেয় অলৌকিক বিশ্বাসের কাছে। সুন্দরবনের মানুষের সেই বিশ্বাস থেকে লোকদেবী ‘বনবিবি’র জন্ম।
শোনা যায়, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এক গ্ৰামে এক বিধবা মহিলা ও তাঁর ছেলে বাস করত। ছেলেটির নাম ছিল দুখে। দুখের দুই জ্ঞাতি কাকা ছিল, পাশের গ্ৰামের ধনা ও মনা। একদিন দুখেকে নিয়ে তারা মধু সংগ্রহ করতে বনে যায়। বনে যাওয়ার সময় দুখের মা ছোট্ট ছেলেকে বলেন, বনে তার আরেক মা রয়েছে। বিপদে পড়লে যেন তাকেই স্মরণ করে দুখে। তিনিই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
গাজী আউলিয়া গভীর বনে বাস করতেন। বাঘরূপী দক্ষিণ রায় থাকতেন বনের প্রহরায়। মধু শিকারে এসে দুখের মন খারাপ। সে সারাদিন মায়ের জন্য কেঁদে চলেছে। কতক্ষণে মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে সে’কথাই ভেবে চলেছে। এক রাতে দক্ষিণ রায় ধনা,মনার স্বপ্নে এলেন। মধু ও প্রচুর ধনসম্পত্তি দিলেন। তবে শর্ত একটাই, দুখেকে উৎসর্গ করতে হবে। নইলে নৌকা ডুবিয়ে দেবেন। ধনা, মনা রাজি। পরিত্যক্ত এক দ্বীপে দুখেকে ফেলে আসল দুই কাকা। দুখের মনে পড়ল তার মায়ের বলা কথা। বনে আরেক মা রয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সেই মাকেই স্মরণ করল দুখে। দুখের সামনে এসে দাঁড়াল এক অপরূপ সুন্দরী দেবী। হাতে তার ধারালো তলোয়ার। তিনিই বনবিবি, সুন্দরবনের রক্ষাকর্ত্রী। দুখেকে কোলে তুলে নিল। কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত ঘটনা সে জানাল বনবিবিকে। ক্রোধে ক্ষিপ্ত বনবিবি, ভাই শাহ জঙ্গলীকে আদেশ দিলেন রণসাজে সজ্জিত হয়ে দক্ষিণ রায়কে পরাস্ত করার। শাহ জঙ্গলি দক্ষিণ রায় ও গাজি আউলিয়াকে এনে হাজির করেন বনবিবির পায়ের সামনে। দক্ষিণ রায় উপায় না দেখে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করেন। বনবিবির মূর্তির সঙ্গে থাকে একটি ছোট্ট ছেলের মূর্তি। সেই দুখে। সুন্দরবনের সমস্ত প্রাণীদের রক্ষার করার দায়িত্ব বনবিবির।
আরেক লোকগাথা অনুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায় হলেন দণ্ডবক্ষ ও রায়মনি নামক রাক্ষস দম্পতির সন্তান। তারা পিশাচ সৈন্য নিয়ে সুন্দরবন দখল করেছিলেন। দক্ষিণ রায় ছিলেন পরাক্রমী আর অত্যাচারী। বাঘের রূপ ধরে তিনি মানুষের ঘাড় মটকাতেন। মক্কার ফকির নিঃসন্তান ইব্রাহিম সন্তান লাভের আশায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পত্নী গোলালমবিবি সন্তানসম্ভবা হলে প্রথম স্ত্রীর প্ররোচনায় ইব্রাহিম তাকে জঙ্গলে ছেড়ে আসেন। গোলালবিবি বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীকে জন্ম দেন। সাত বছর পর ইব্রাহিম ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রী সন্তানদের মক্কায় ফিরিয়ে আনেন।
নামাজ পড়ার সময় দুই ভাইবোন অজান্তে যাদু টুপি মাথায় দিয়ে পৌঁছে যায় আঠারো ভাঁটির দেশে। জঙ্গলে ভাই বোনের নামাজের সুর শুনে দক্ষিণ রায় রেগে কাঁই। ঠিক করলেন সম্মুখ সমরে নামবেন। দক্ষিণের মা রায়মনি বোঝালেন নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করা পুরুষের মানায় না। তিনি নিজেই এলেন যুদ্ধ করতে। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব হল। তারা ভাগ করে নিলেন সুন্দরবনকে। বনিবিবি পেলেন মনুষ্য বসতি, আর দক্ষিণ রায় নিলেন অরণ্য।
বনবিবির দু’রকম মুর্তি দেখা যায়। একটিতে তার মাথায় থাকে টুপি, চুল বিনুনি করা, কপালে টিকলি, গলায় হার, পরনে পাজামা, পায়ে জুতো, কোলে একটি বালক। কোথাও তিনি বাঘের পিঠে, আবার কোথাও মুরগির পিঠে। অন্য এক মুর্তিতে দেখা যায়, মাথায় মুকুট, গলায় হার ও বনফুলের মালা, সর্বাঙ্গে নানা অলংকার এবং কোলে বা পাশে দুখের মূর্তি। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনে মহাসমারোহে বনবিবির পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজো উপলক্ষে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ জমায়েত হন। উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা-সহ বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলিতে মেলা বসে বনবিবির পুজোকে ঘিরে।