পুজো স্পেশাল বিভাগে ফিরে যান

বিশালাক্ষী : আজও বাংলার প্রতিটি প্রান্তে নানা রূপে পূজিত এই দেবী

February 6, 2024 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দেবী বিশালাক্ষীর পুজোর প্রচলন আছে। সুন্দরবন এলাকাসহ একাধিক অঞ্চলে কৃষিজীবী, জলজীবী এবং বনজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ এই দেবীর আরাধনা করেন। তবে বিশালাক্ষী দেবীর একাধিক রূপে নানা রকম ভাবে পূজিত।

গত ৩০০ বছর ধরে নানুরে চণ্ডীদাস সৃষ্ট বিশালাক্ষী মন্দিরে জাঁকজমকসহকারে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। এর মধ্যে ভট্টাচার্য পরিবারের বিশালাক্ষী মন্দিরের পুজো খুব বিখ্যাত। জানা গিয়েছে, এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ সপ্তমীর সকালে শুয়োর বলি। মহাষ্টমীতে সন্ধিপুজোর বলিদান হয় জলঘড়ি দেখে‌।

জনশ্রুতি, ৬০০ বছর আগে নানুরে কবি চণ্ডীদাস বাসুলি মায়ের পুজো করতেন। পরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় মন্দির সংলগ্ন এলাকা। পরিণত হয় উঁচু ঢিপিতে। ৩০০ বছর আগে নানুর সংলগ্ন শাকুলিপুর গ্রামের তেলি সম্প্রদায়ের এক গৃহবধূকে দেবী বাসুলি স্বপ্নাদেশ দেন। দেবী জানান তিনি কোথায় আছেন। একথা তাঁর পরিবার ও স্থানীয়দের জানানোর পরেই মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। এরপর ওই গৃহবধূর কথা মতো উঁচু ঢিপি খনন করে বাসুলি দেবীর মূর্তি উদ্ধার করা হয়। মহালয়ার আগে নবমী তিথিতে বাসুলি দেবী প্রথম পূজিত হন বলে তখন থেকে নবমীর দিনই বোধন হয়ে আসছে এই পুজোর।

কোনও কোনও এলাকায় শাসন পুজো হিসেবে প্রচলিত বিশালাক্ষী পুজো। সপ্তমীর সকালে কলাবউ ও দোলা নিয়ে উত্তর দিক থেকে অন্যান্য পুজো কমিটি সমবেত হয় বিশালাক্ষী মন্দিরে। এরপর নানুরের দক্ষিণ দিকের একটি পুকুরে শোভাযাত্রা সহকারে ঘট ভরতে যাওয়া হয়। ফেরার পথে শুয়োর বলিদান করা হয়। জনশ্রুতি, বর্গিদের অত্যাচার ঠেকাতে বাসুলি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই বলিদান শুরু হয়।

বাঁকুড়ার ছাতনা অঞ্চলে চণ্ডীদাস পূজিত বাসুলি মায়ের পুজো এখানে ধর্মপুজো বিধান অনুসারে হয়। বস্তুত ছাতনা অঞ্চলে মায়ের যে মূর্তি পাই, এই রূপেই মা বাসুলিরাঢ়ভূমিতে অধিকতর জনপ্রিয়ভাবে অধিষ্ঠিত। মা এখানে দ্বিভুজা। ডান হাতে খড়্গ এবং বাঁ হাতে খর্পর ধারণ করেন। মায়ের মুখে প্রশান্ত হাসি, মা মুণ্ডমালিনী। দেবী এখানে দুই পায়ে দুটি পুরুষমূর্তিকে দলন করেন, মায়ের একটি পা একদিকের শায়িত পুরুষমূর্তির জঙ্ঘায় অপর পা অপর পুরুষমূর্তির মস্তকে স্থাপিত, যে দুটি পুরুষমূর্তি এখানে অসুর বলে মনে করা হয়।

হুগলির পুরুষোত্তমপুরের যে সড়কটি গিয়ে জাতীয় সড়কের সঙ্গে মিশেছে সেই রাস্তার পাশেই রয়েছে বিশালাক্ষী মন্দির। একেবারেই ভাঙাচোরা মন্দির হলেও এখনও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা প্যানেলটি রয়ে গেছে। তাতে লেখা ১১৩৮ বঙ্গাব্দ। ২৯১ বছরের পুরনো মন্দির। ওই প্যানেলে আরও কতকগুলো সংখ্যা রয়েছে। এগুলো হল, ১৬৬২। এটি সম্ভবত শকাব্দ। সংখ্যাগুলো খ্রিস্টাব্দে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায় ১৭৪০।

প্রাচীন কৃষ্ণবল্লভপুর অথবা বলদবাঁধ গ্রামে দেবী বিশালাক্ষী মূর্তি অতি বিশাল। ৮ ফুট উচ্চ দেবীমূর্তি চতুর্ভুজা। তাঁর বাম হস্তদ্বয় সশস্ত্র, দক্ষিণ হস্তদ্বয় বরাভয় মুদ্রা। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। প্রস্থ ৩১ ফুট। গর্ভ গৃহে প্রবেশের মুখটি খিলানাকৃতির। সেই খিলানের ব্যাস ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরচত্বর ১৮ কাঠা জমির উপরে অবস্থিত। মা বিশালাক্ষীর মন্দিরটির উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে কানা নদী। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট ৬ ইঞ্চির প্রস্থের একটি বাঁধানো বেদীর উপরে দেবীর অবস্থান।

দেবীর গাত্র বর্ণ কাঁচা হলুদ, পরনে নীল পাড় লাল শাড়ি। যদিও পুজো পার্বন ও ভক্ত গনের দেওয়া কাপড় পরিবর্তন করা হয়। পদতলে শায়িত রয়েছেন শ্বেতবর্ণ কৃত্তিবাস মহাদেবস্বরূপ মহাদেব। তাঁর অর্ধনিমিত চক্ষু, মাথায় জটা। ডান হস্ত মাথার তলায় দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছেন।বাম পা সামনের দিকে, ডান পা টি পিছনের দিকে। ত্রিনয়ন মহাকালের কণ্ঠদেশে রুদ্রাক্ষের মালা, হস্তে রুদ্রাক্ষের বলা, কর্ণে ধুতুরা ফুল। অহিভূষণ মহাকালের বাম হাতে ডমরু ও কলকে। হাতটি কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বমুখী। সেই হাতের কনুইয়ের ভাঁজে হরিদ্রাভ মুন্ড। মুন্ডের কাটা গলা হতে রক্ত ঝরছে। মুন্ডের বিশাল চক্ষু, পুষ্ট গোঁফ, কপালে রক্ত তিলক। মহাকালের পিছনে আরেকটি হরিৎ বর্ণের নরমুন্ড। তার ঘনসবুজ মুখ বর্ণ, তার মাথায় বাবরি চুল, পাকানো গোঁফ, বিস্ফারিত দৃষ্টি। দেবী বিশালক্ষীর দেহের গঠন পুরুষালী । তাঁর গলদেশে তেরোটি মুন্ডের মালা। তিনি মুক্তকেশী ও আয়তলোচনায় বিশাললোচনী তাই তাঁর নাম বিশালাক্ষী।

পৌরাণিক তথ্য বলছে, উত্তরপ্রদেশের বারাণসী বা বেনারসের এই স্থানে দেবী সতীমায়ের কানের দুল বা চোখ পড়েছিল। তাই এই পীঠস্থান বিশালাক্ষী সতীপীঠ নামে পরিচিত। বিশাল অক্ষী অর্থাৎ দেবীর দিব্যনেত্র পড়েছিল বলেই এরূপ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে বিশালাক্ষী দেবীকে যে রূপেই পুজো করা হোক না কেন তিনি বাংলায় প্রায় সর্বত্রই পূজিত তা বলাই যায়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#West Bengal, #Vishalakshi temple, #Vishalakshi

আরো দেখুন