কেমন ছিল গণিতশিল্পী কেসি নাগের জীবন
শৌভিক রাজ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: তৈলাক্ত বাঁশ হোক বা ফুটো চৌবাচ্চা, নিদেন পক্ষে পিতাপুত্রের বয়সের হিসেব কষা কোনও একটি অঙ্কে ঘায়েল হয়ে হয়ত আপনি আজও দুষছেন কেসি নাগ-কে! যেমনটা আমাদের পাড়ার পটলাদা করে যাচ্ছেন আজীবন। ম্যাট্রিকে তিনি তিন তিনবার অঙ্কে ডাব্বা মেরেছেন। কারণ কী জানেন? কারণ কেসি নাগ। একবার তৈলাক্ত বাঁশে, আরেকবার ফুটো চৌবাচ্চা ভর্তি করার হিসেব করতে গিয়ে আর শেষবার বাবা-ছেলের বয়স বের করতে গিয়ে তিনি গেরোয় পড়েছেন। ম্যাট্রিক আর পেরোনো হয়নি।
অঙ্ক কি কঠিন? সত্যিই অঙ্ক কী কঠিন!
বাঙালির জীবন কেসি-তেই আটকে, গ্রীষ্ম-বর্ষায় ছাতা কে সি-র, রসগোল্লায় খাওয়াতেও কেসি আবার রসগোল্লা পাইয়ে দিতেও কেসি। শেষের দুটোর দ্বৈত মানে রয়েছে, রসগোল্লার জন্য কেসি দাশ তো আছেই কিন্তু কেসি নাগও আপনাদের রসগোল্লা খাইয়ে থাকতে পারে, অঙ্ক পারলে হিট আর না পারলেই ফ্লপ। হয় রসগোল্লা পাবেন, নয় খাবেন। যাই হোক অঙ্ক ভীতি একটা মিথ, এবার ফেরা যাক আসল কথায়। আজ কেসি নাগের জন্ম দিন। ১৩০০ বঙ্গাব্দে ওঁর জন্ম হয়েছিল। এটা ১৪৩০ অর্থাৎ ১৩০ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন। ১০ জুলাই ১৮৯৩ সালের নাগপাড়া, গুড়াপ, হুগলিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দিনটা ছিল রথযাত্রা।
তৈলাক্ত বাঁশ দিয়ে উঠতে গিয়ে, একটি বাঁদর একবার উঠছে, আবার পড়ে যাচ্ছে। কতক্ষণে বাঁশের মাথায় উঠবে বাঁদরটি? ফুটো থাকা চৌবাচ্চা দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার জল ভরা হচ্ছে। কতক্ষণে ভরবে চৌবাচ্চাটি? প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে গতিময় ট্রেন, তার দৈর্ঘ্য কত? এমন হরেকরকম অঙ্ক কষতে হয়নি এমন পড়ুয়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেসি নাগ একদিকে ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক, অন্যদিকে গণিতের শিল্পী। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নাম দিয়েছিলেন গণিতশিল্পী। শুধু অঙ্ক নয় অঙ্কের ভাষাও তিনিই তৈরি করেছিলেন। কিংবদন্তি অঙ্কের মাস্টারমশাইকে শৈশবে বাড়ি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার হেঁটে অঙ্ক শিখতে যেতে হত। রঘুনাথ নাগ ও ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবীর ছেলে কেশবই, আমাদের সকলের কেসি নাগ।
গুড়াপেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। সপ্তম শ্রেণিতে উঠেই ভর্তি ছিলেন ভস্তারা যোগেশ্বর হাই স্কুলে। শোনা যায়, এই সময়ই অঙ্কের প্রতি আগ্রহ জন্মায় কেশবচন্দ্রের। অঙ্কের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে পরবর্তীকালে বাংলা তথা দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্কের শিক্ষক তৈরি করেছিল। আসলে প্যাশন না থাকলে হয়?
নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। পরবর্তীতে রিপন কলেজ যা আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ; সেখান থেকেই ১৯১২ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি পাওয়া তখনও ঢের বাকি! আইএসসির পর যোগেশ্বর স্কুলে ছাত্র পড়ানো শুরু করলেন কেশবচন্দ্র। শিক্ষক জীবন শুরু হল।
বড় সংসার, তাই স্কুলের পাশাপাশি চলত টিউশন পড়ানো। পাশাপাশি ভালবাসার বিষয় অঙ্ক নিয়েই স্নাতক হলেন কেশবচন্দ্র। সঙ্গে সংস্কৃত এবং কলাবিদ্যা। পেলেন বিএ ডিগ্রি। তারপর নিজের শৈশবের স্কুল কিষেণগঞ্জে গণিতের শিক্ষক ছিলেন বেশ কিছুদিন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলেও পড়িয়েছিলেন তিনি। অঙ্কের জটিল সমস্যার সহজ সমাধান খোঁজা তখন কেশববাবুর নেশা। পড়ুয়াদের অঙ্কভীতি কী করে দূর করা যায়? সহজ উপায়ে জটিল অঙ্কের উত্তর খোঁজা যায়-ই বা কী করে! অনুসন্ধান শুরু করলেন।
খ্যাতি ছাড়িয়ে পড়ল। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে এলেন, ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। অবসর অবধি এই মিত্র ইনস্টিটিউটেই পড়িয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। এখান থেকেই প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। কলকাতায় প্রথমে তাঁর ডেরা ছিল রসা রোডের মেস। পরে দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনে বাড়ি তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু তাঁর বই লেখা শুরু কীভাবে?
শিক্ষকতা নিয়েই মগ্ন ছিলেন কেশবচন্দ্র। মিত্র ইনস্টিটিউটে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবি কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা। মধ্যমণি ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্যপ্রেমী কেশবচন্দ্রও থাকতেন ওই আড্ডায়। লোক মুখে শোনা যায়, কালিদাস রায়ের বাড়ির এই সাহিত্য আড্ডায় কেশবচন্দ্রকে অঙ্কের বই লেখার প্রস্তাব দেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র। কবিশেখর কালিদাস তাঁকে প্রথম বলেছিলেন অঙ্কের বই লেখার কথা। কেশবচন্দ্রের অঙ্কের ক্লাস ছিল সাহিত্যের মতোই প্রাঞ্জল। ছাত্ররা ক্লাস করতে মুখিয়ে থাকত। শরৎচন্দ্র এবং কালিদাসের উৎসাহেই প্রথম বই লেখেন কেশবচন্দ্র। কেশবচন্দ্র ভবানীপুরের ১২ নম্বর রসা রোডের মেসে বসেই লিখে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম বই, পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য “নব পাটীগণিত”। তিনের দশকে ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। যেন হট কেক! দ্রুত জনপ্রিয় হল কেসি নাগের পাঠ্যপুস্তক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কেশবচন্দ্রকে। তবে প্রথম বইটি নয়, কেসি নাগকে কিংবদন্তি বানিয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় বই ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স।
কী করে লেখা হল ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স?
ক্যালকাটা বুক হাউস-এর কর্ণধার পরেশচন্দ্র ভাওয়াল এক দিন কেশবচন্দ্রের ঘরে এসে দেখতেপেলেন, টেবিলের উপরে মোটা একটা খাতায় পাতার পর পাতাজুড়ে অঙ্ক। শুধু অঙ্কই নয়, কোন অঙ্ক কী ভাবে, কত রকম ভাবে করা যাবে, গুছিয়ে লেখা। পরেশবাবু চাইলেন সেই খাতা, বই ছাপবেন। কেশবচন্দ্র কিছুতেই দিতে রাজি নন, ছেলেমেয়েরা অঙ্ক শেখার আগে অঙ্কের “মানে বই” হাতে পেলে বিপদ। পরেশবাবু বোঝালেন, অঙ্কের শিক্ষকদের জন্য খুবই দরকারি বই হবে, তাঁদের জন্য অন্তত প্রকাশ করা দরকার। রাজি হলেন কেশবচন্দ্র। ১৯৪২-এ বেরোল ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। ‘নব পাটীগণিত’-এর মতোই, মার্কেট ও মন, দুই-ই জয় করল। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের শিক্ষক। মোট ৪২টা বই লিখেছেন। তাঁর বই নানান ভাষায় অনুদিত হয়েছে, পাকিস্তানের বোর্ডের জন্যেও তিনি বই লিখেছেন। ব্রেইলেও রয়েছে তাঁর বই।
ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন কেশবচন্দ্র?
বই লেখা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যুক্ত থেকে ছিলেন তিনি। গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছিলেন বেশ কিছুদিন। মা সারদার কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন, মায়ের জপ করে দেওয়া মালা জপ করতেন প্রতিদিন। স্কুল, লাইব্রেরি, রাস্তা, সেবা সংস্থা তৈরি করে, কেশবচন্দ্র পাল্টে দিয়েছেন গুড়াপকে। আজও তাঁর লেখা বইয়ের চাহিদায় কিন্তু এক ইঞ্চিও ভাঁটা পড়েনি। বই বিক্রির সমস্ত টাকা চলে যায় তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী দেবীর নামে বানানো ফান্ডে।
উত্তম-সুচিত্রার ফ্যান ছিলেন তিনি। মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতেন তিনি, গজা খুব প্রিয় ছিল।মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্যতালিকায় এক নম্বরে গোষ্ঠ পাল, আর দ্বিতীয় নামটাই তাঁর, কেশবচন্দ্র নাগের। মোহনবাগান ম্যাচ হারলে সে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়তেন।
এই খেলাই ডেকে এনেছিল মৃত্যু!
রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনতেন। সেই ধারাবিবরণী শুনতে শুনতেই একদিন মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু। ডাক্তারি পরিভাষায়, ‘ইন্টারনাল হেমারেজ’। ১৯৮৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান কিংবদন্তি শিক্ষক।