নামে পাতি হলেও কাজে নয়, তাই সকলে গায় লেবুর গুণগান
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: লেবু বাঙালির খাবার টেবিলে একটি অন্যতম সহায়ক সবজি। খাবার টেবিলে এবং সালাদে লেবু ছাড়া তো ভাবাই যায় না। এর স্বাদ বৃদ্ধির ভূমিকা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিশেষ খাদ্যগুণ। কিন্তু এই লেবু কোথা থেকে এসেছে?
সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়। ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার (১৬২৬-১৬৮৮) বাংলা ভ্রমণ করছেন। বাংলার গরমের হাত থাকে বাঁচতে ভ্রমণের সময় তিনি সঙ্গে রাখতেন লেবু। যখনই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তেন, লেবু খেতেন বার্নিয়ার। তাতে তাঁর ক্লান্তি কেটে যেত।
ক্লান্তি ভোলার জন্য শুধু বার্নিয়ারই এভাবে লেবু খেতেন না। ভরদুপুরে বাড়িতে কেউ এলে ভিটায় বোনা লেবু ছিঁড়ে এনে ঠান্ডা জলে শরবত বানিয়ে পান করতে দেওয়া ছিল বাঙালি ‘কালচারের’ সহবত। এতে অতিথির যেমন ক্লান্তি দূর হতো, তেমনি বাড়ির লোকজন নিজেদের সম্মানিতও মনে করতেন।
ঠিক কবে লেবু বাঙালির হলো? এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া সম্ভব নয়। বাঙালির খাদ্যকোষ বইয়ে মিলন দত্ত জানাচ্ছেন, লেবু শব্দটি মুণ্ডারি শব্দ ‘নুম্বক’ থেকে সংস্কৃত ‘নিম্বুক’, তারপর হিন্দি ‘নিম্বু’ থেকে বাংলায় এসেছে। লেবু বা নিম্বু ভারতীয় ফল বলে জানা যাচ্ছে শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত ‘বিশ্বকোষ’ থেকে। এটি ভারত থেকে মেসোপটেমিয়া এবং বর্তমান ইরানের পশ্চিম ও উত্তর অংশের মাঝে অবস্থিত প্রাচীন মিদিয়া সাম্রাজ্যে বিস্তার লাভ করে। এই মিদিয়া থেকে লেবু ইউরোপে পাড়ি জমায়।
বাঙালি বাড়ির ভিটায় লেবুগাছ বা ঝোপ থাকবে, এটা ছিল খুব সাধারণ একটা দৃশ্য। দুপুরের খাবারের সঙ্গে সম্পন্ন বাঙালি গৃহস্থের পাতে একটুকরা কাগজি লেবু থাকবে না, সেটা অকল্পনীয় ব্যাপার। বড় কানাতোলা কাঁসার থালার ঠিক মধ্যে সাজানো ধবধবে সাদা ভাত, তার পাশে একটুখানি লবণ আর লেবু, তার পাশে সাজানো অষ্টব্যঞ্জন—এই ছিল সম্পন্ন বাঙালি গৃহস্থের খাবারের কেতা। ডালে চিপে দেওয়া লেবু আর ব্যঞ্জনের ঘ্রাণ যে ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলত, সেটা না বললেও চলে।
লেবু নিয়ে অন্য একটি তথ্যও আছে, বুনো লেবুর গন্ধ ছড়াত মায়োসিন যুগের শেষ দিকে। সে কোন সময়? মোটামুটি ২৫ মিলিয়ন থেকে ১৩ মিলিয়ন বছর আগের কথা। এ পৃথিবীতে লেবুর বাস আট মিলিয়ন বছর ধরে। ইতিহাসবিদরা বলেন, হিমালয়ের পাদদেশে প্রথম দেখা গিয়েছিল তাদের। ক্রমে ক্রমে লেবু ছড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। সেখানে অবশ্য কালে কালে বেশ ‘জাতের ফল’ হয়ে ওঠে এটি।
গ্রিক রান্নায় একটা নিয়মিত উপাদানের মধ্যে পড়ত লেবু। আগ্রহ জাগানোর মতো আরও একটি বিষয় হল, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে অদৃশ্য কালি তৈরিতে ব্যবহার করা হতো লেবু। এই কালির মাধ্যমে পার্সিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করত গ্রিসের মানুষ। এছাড়া প্রাচীন গ্রিসে পাতিলেবু ছিল অলিভ অয়েলের আদর্শ সঙ্গী। রান্নাঘরের অতি প্রয়োজনীয় ফলটির রূপচর্চাতেও দর পেতে সময় লাগেনি।
বলে রাখা ভালো, শুধু গ্রিস নয়, প্রাচীন রোমান সভ্যতায় লেবু হয়ে উঠেছিল অভিজাত মহলের স্টেটাস সিম্বল। অর্থাৎ ধনীদেরই একমাত্র ক্ষমতা ছিল এ ফল কিনে রাখা এবং কাজে লাগানোর। এ তথ্য কিন্তু খুব অতীতে পাওয়া নয়। মাত্র বছর পাঁচেক আগে গবেষণায় উঠে এসেছে খ্রিস্টের সময় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আসা প্রথম ফলের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল লেবু। ইজরায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রাচীন লেখা, শিল্প, প্রত্নসামগ্রী, জীবাশ্ম ঘেঁটে জানতে পেরেছেন এই তথ্য। প্রথম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও লেবু ছিল রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য এবং দামি। ওই গবেষকদলের তরফেই জানা যায়, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এখন যেমন লেবুর বাগান খুব স্বাভাবিক একটা দৃশ্য, প্রাচীনকালে তা ছিল না। বস্তুত লেবু এসেছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে। জেরুজালেমের কাছে পার্সিয়ান রাজপরিবারের বাগানে পাওয়া গিয়েছিল লেবুর সুপ্রাচীন জৈব প্রমাণ, খ্রিস্টপূর্ব ৫-৪ শতকের কথা। ধরে নেওয়া হয় ওখান থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
এবার আসা যাক একালে টক ফলটির বহুল ব্যবহারে। রূপচর্চায় আজকাল চলতে ফিরতে শোনা যায় ভিটামিন সি আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কথা। লেবুতে ভরপুর রয়েছে দু’টি উপাদানই। ত্বকে ডার্ক স্পট বা স্কিন টোন ঠিক করতে যার জুড়ি মেলা ভার। লেবুতে আছে সাইট্রিক অ্যাসিড যেটা প্রাকৃতিকভাবে এক্সফোলিয়েশনের কাজ করে, ত্বকের মৃত কোষ দূর হয়ে ঝকঝকে উজ্জ্বল ত্বক হয়। অ্যাকনের সমস্যায় ভোগেন যাঁরা, তাঁদের জন্য লেবুর রস খুব ভালো সমাধান। এসবের সঙ্গে উপরি পাওনা কী কী বলুন তো? ত্বকে কোলাজেন বাড়াতেও সাহায্য করে লেবু। ত্বক টানটান রাখা এবং মুখের বলিরেখা কমানোর কাজে সিদ্ধহস্ত সাইট্রিক অ্যাসিড।
সাইট্রিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন সি-র প্রাবল্য থাকায় লেবু থেকে তৈরি তেল বা লেমন অয়েলের সাহায্য কটু গন্ধ দূর করার উপায় খোঁজেন অনেকে। এছাড়াও লেবুকে কাজে লাগানোর সহজ রাস্তা আছে। লেবুর রস জলে মিশিয়ে পাতলা করে তুলোয় করে ত্বকের বিভিন্ন অংশে লাগাতে পারেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, কখনওই লেবুর রস সরাসরি ত্বকে লাগাবেন না। তাতে হিতে বিপরীত হবে, ত্বক জ্বালা করবে। তাছাড়া মনে রাখুন আর একটা কথা। জলে বা অন্য কোনও উপাদানে মেশানো লেবুর রস ত্বকে প্রয়োগ করার পরপরই কখনও সূর্যালোকে বেরবেন না। কারণ তাতে সানবার্ন এবং হাইপারপিগমেন্টেশন হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। লেবুর রসের অ্যাসিডিক উপকরণে ত্বকের সাধারণ পিএইচ ব্যালান্স নষ্ট হতে পারে। তাতে ত্বকের আর্দ্রতা কমে ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। কারও কারও সাইট্রাস অ্যালার্জি থাকতে পারে। না জেনে তাই ত্বকে কিছুই প্রয়োগ করবেন না।
এবার আসা যাক অন্য উপকারের কথায়। লেবুর রসে তৈরি ফেস স্ক্রাবও খুব সহজে বানিয়ে ফেলতে পারেন। চিনি, লেবুর রস আর অলিভ অয়েল একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। এবার এই মিশ্রণ সার্কুলার মোশনে চোখের আশপাশ বাদ দিয়ে সারা মুখে লাগান। তারপর উষ্ণ জলে ধুয়ে ফেলুন। একইসঙ্গে লেবুর রসকে টোনার হিসেবেও কাজে লাগাতে পারেন। তিনভাগ ডিসটিলড ওয়াটার বা পরিশোধিত জলে একভাগ লেবুর রস মিশিয়ে রাখুন। ওই জলটা দিয়ে তুলোয় ভিজিয়ে পরিষ্কার মুখে লাগান প্রতিদিন সন্ধেবেলা একবার করে।
প্রাকৃতিকভাবে ফেস মাস্কও তৈরি করে নিতে পারেন লেবু দিয়ে। মধু, দই আর লেবুর রস মিশিয়ে নিন একসঙ্গে। এটা মুখে মেখে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে ফেলুন। মুখের ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে এটা দারুণ উপায়। এছাড়া নারকেলের জলের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে সেটাও লাগাতে পারেন। নারকেলের জল ত্বককে আর্দ্র রাখে। আর লেবু ত্বককে করে উজ্জ্বল করে। তবে এই মিশ্রণটি সেনসিটিভ স্কিনের জন্য প্রযোজ্য নয়। হাতের চামড়ায় প্যাচ টেস্ট না করে এগুলো সরাসরি মুখে প্রয়োগ করবেন না।
মুখের যত্নের তো শেষ নেই। কিন্তু একটু কনুই বা হাঁটুর দিকেও তো নজর দিতে হয়। এই অংশগুলোয় বিভিন্ন কারণে কালো ছোপ তৈরি হয়ে যায়। সেটা দূর করতে লেবুতে থাকা ভিটামিন সি খুব কার্যকর। যেসব জায়গায় এমন কালো ছোপ রয়েছে, তাতে পাতিলেবু হাফ করে কেটে আস্তে আস্তে বুলিয়ে নিন। সপ্তাহে বার কয়েক নিয়মতি করলে ফল পাবেন।