জীবনের অপর নাম জীবনানন্দ দাশ
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসসচেতন কবি। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ও তার অনন্যতা বিষ্ময়কর। বিশেষতঃ কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দের নৈপুন্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা’ পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবন বোধকে নাড়া দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তার কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা- পুরাণের জগৎ তার কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্র রূপময়। বিশেষত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসুক্ষè সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে তিনি রূপসী বাংলার কবি হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। তার কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে আমরা অনায়েসে ঘনিষ্ঠ বোধ করি। এটি তার জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ। যে প্রকৃতির বর্ণনা জীবনানন্দ করেন, বাস্তবে তাকে আমরা আর খুঁজে পাই না। পাই না বলেই হয়তো হারানো সেই সৌন্দর্যকে আমরা নিজের ভেবে আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরি। অনেক সময় তার উচ্চারিত শব্দ চিত্র আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েগেছে। স¤্রাট বিম্বিসার কে, বির্দভ নগর কোথায়, তা’না জেনেই মনে মনে নিজের মতো এক চিত্র ও ধ্বনির জগৎ আমরা গড়ে নেই।
আগাগোড়া তার কবিতার সুর বিষন্ন, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে রং তাও ধূসর, অথচ তা’ সত্ত্বেও জীবননান্দ দাশের কবিতায় আমরা ব্যক্তিগত প্রণোদনার উৎস খুঁজে পাই। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্প জগতে মূর্ত হয়েছে, বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগর জীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয়, রোধে জীবনানন্দ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি। তিনি ইতহাস চেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক সূত্রে বেঁধেছেন।
তার কবি স্বভাব ছিল অন্তর্মুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরচেতনার শব্দ রূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। এ সূত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন ইম্প্রেশনিস্টিক রীতি, পরাবাস্তবতা, ইন্দীয় বিপর্যাস ও রঙের অত্যাশ্চর্য টেকনিক। জীবনানন্দ বাংলা কাব্য সাহিত্যের যে অজ্ঞাত পূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছিলেন তা জীবনানন্দের সমকালীন সময়ে খুব কম কাব্য রসিক কিংবা নন্দন তাত্ত্বিকরা বুঝতে পেরেছিলেন।
জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্য জীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌন সম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তার প্রায় গল্প উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জীবনান্দের কবিতার ভূমিকা ঐতিহাসিক। ষাটের দশকে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বাঙালি জনতাকে তার “রূপসী বাংলা” তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে।
জীবনানন্দ ছিলেন আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। বিশ শতকের অন্য কোনো বাঙালি কবি আমাদের কল্পনায় এমন প্রবলভাবে দাগ কাটেনি। আজও তার কবিতার অলঙ্কার শব্দ ব্যবহার এবং অধুনা আবিষ্কৃত গদ্যের ভাষা আমাদের ক্রমেই বিস্মিত করে চলেছে।