ভারতের নানা প্রদেশে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2024/02/Bhasha-Andolan-1024x576.jpg)
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: ১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সেই থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯৯০ এর দশকে এই আন্দোলনকে কুর্নিশ জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
বাঙালী হিসেবে আমাদের আত্ম-উপলব্ধির অন্যতম প্রধান চেতনা ভাষা আন্দোলন। শুধু পূর্ববঙ্গে নয় স্বাধীন ভারতবর্ষেও এই ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন মানুষ, জানেন কি?
আসুন জেনে নিই সেই ইতিহাসের কিছু অধ্যায়:
বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন
অসমে অসমীয়া ভাষাকেই রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বাংলাভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী বাংলা ভাষীরা আন্দোলনে নামে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচরে পুলিশ হত্যা করে।
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2020/02/barak-valley-language-movement-1024x576.jpg)
ওই দিন ২:৩৫ নাগাদ শিলচর স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিল। দু’জন পরে মারা যান । ২০ মে শিলচরের লোকজন শহীদদের শবদেহ নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে কে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মানভূম ভাষা আন্দোলন
অবিভক্ত ভারতে ১৯১২ সালে মানভূম জেলাকে ভারতের বিহার ও ওড়িশার সাথে যুক্ত করা হলে মানভূমবাসী তাদের জেলাকে বাংলার সাথে যুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2020/02/মানভূম-ভাষা-আন্দোলন-1024x576.jpg)
ভারত সরকার তৎকালীন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলায় বসবাসকারী বাংলাভাষী মানুষদের মধ্যে জোর করে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দিতে গেলে তারা বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলন করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে নতুন জেলা তৈরী করতে সরকারকে বাধ্য করেন।
১৯৫৬ সালের আগে পুরুলিয়া বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজনৈতিক ভাবে বিহারের স্কুল-কলেজ-সরকারি দপ্তরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে আন্দোলন করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু, বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অবশেষে পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবী রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল লোকসেবক সঙ্ঘ গড়ে তোলেন।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে তাদের সুদৃঢ় আন্দোলন করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ এই আন্দোলন তীব্র ভাবে প্রতিভাত হয়।
নেলি গণহত্যা
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের অসমে সংঘটিত হয়েছিল নেলি গণহত্যা। ৬ ঘন্টা ধরে সংঘটিত এই গণহত্যায় কেড়ে নেওয়া হয় নগাঁও জেলার ১৪টি গ্রামের নেলির ৫,০০০-এরও বেশি মানুষের জীবন।
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2020/02/নেলি-গণহত্যা-1024x576.jpg)
এই দিন সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে, হঠাৎ তিনদিক থেকে সশস্ত্র আততায়ীরা গ্রামগুলিকে ঘিরে ফেলে। গ্রামবাসীরা কপিলি নদীর দিকে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু নদীতেও পরিকল্পিতভাবে নৌকা নিয়ে আক্রমণকারীরা অপেক্ষা করছিল। প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে ছুরি, কাটারি, কুঠার, শাবল, বর্শা, গোদা বন্দুক দিয়ে হত্যালীলা চালানো হয়। তারপরে প্রাণভয়ে মানুষ যখন পালানোর সময়, গুলি বা তীর ছোঁড়ে। এছাড়া সমস্ত বাড়িঘর ও ধানের গোলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এনআরসি, নাগরিকত্ব এবং
২০১৮ সালের ৩১শে জুলাই অসমে জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির খসড়া প্রকাশ করে রাজ্য সরকার। দেখা যায় ৪০ লক্ষ লোকের নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। সাধারণ, গরিব মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে লড়ে যায় নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে। এরপর ২০১৯ সালে যখন জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়, তখন ২০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায়। তার মধ্যেও ১৬ লক্ষ বাঙালি। নির্বিচারে বহু মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। নাগরিকত্ব ইস্যুতে আবারও নিজভূমে প্রবাসী হয়ে গেছে বাঙালি।
প্রত্যেক বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আসে, যায়। দেশজুড়ে পালিত হয় সাড়ম্বরে। সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হাজারো পোস্ট হয়। কিন্তু এই ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিলেন তাদের ইতিহাসটা কতজন জানে? বীর শহীদদের এইটুকু সম্মান কি প্রাপ্য নয়?