অবক্ষয়ের পথে আঞ্চলিক বাংলা ভাষার লালিত্য, কেন জানেন?
সৌভিক রায়
মন খুলে মনের কথা প্রকাশ করার জন্যই ভাষার জন্ম। জন্মের পর থেকেই ধীরে ধীরে শিশু মায়ের ভাষায় কথা বলতে শেখে, আর সেই ভাষাই রয়ে যায় আজীবন। যদিও বেঁচে থাকার তাগিদে, শিক্ষা জীবনে, কর্ম জীবনে অন্য ভাষাও শিখতে হয়। কিন্তু মায়ের ভাষা থেকে যায় হৃদয়ে। মানিকবাবু আগন্তুক ছবিতে ৩৫ বছর পরে দেশে ফেরা ছোটমামাকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, মায়ের ভাষা ভোলা যায় না। আর ভোলা যায় না বলেই মাতৃভাষাকে ‘মাতৃদুগ্ধের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন রবি ঠাকুর।
কিন্তু আজকাল মাতৃদুগ্ধের বদলে ফিডিং বোতলের দুধে বেশি বিশ্বাস করছে বিশ্ব। যুগোপযোগী চটকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা। বাংলাভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়! ভাষার একটি রূপকে প্রামান্য ধরে অন্যগুলিকে উপভাষা আখ্যায়িত করা হয়। আদৌ কি তারা উপ নাকি মূল ভাষার স্বতন্দ্র রূপভেদ?
একটা ভাষা যখন বিস্তীর্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয় এবং বহুদিন ধরে প্রচলিত থাকে; তবে তা বিভিন্নভাবে ভেঙে যায়। এটাই ধর্ম কারণ, ব্যবহারকারীরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা মানুষ। হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান হয় না! বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহারকারীদের জন্যই ভাষার মিষ্টতার জন্ম হয়। এই মিষ্টত্বই বাংলা ভাষার প্রাণ, কিন্তু সেই মিষ্টতাই আজ ক্রমশ লুপ্ত হচ্ছে। প্রাণোচ্ছল ভাষা ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ছে।
শহুরে বাঙালি, বিশেষত কলকাতার বাঙালি যে বাংলায় কথা বলেন; আস্তে আস্তে সেই বাংলাই প্রামান্য হয়ে উঠেছে। শহুরে বাংলাকেই অলিখিত মান্যতা দিচ্ছে সমাজ। ভাষার ক্ষেত্রে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সাংবাদপত্র, সাহিত্যগ্রন্থ, সভা-সমিতির ভাষা এবং হালের পাঁচ দশকে সিনেমা, সিরিয়ালের ভাষাও মানুষকে প্রভাবিত করছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় মানুষকে সংযুক্ত করার সবকটি মাধ্যমেই শহুরে বাংলাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সেটিকেই বিশুদ্ধ বাংলার তকমা দিয়ে এগোচ্ছে সমাজ। যার মধ্যে রয়েছে অজস্র অন্য ভাষার শব্দ, ভুল উচ্চারণ, ভ্রান্ত বানান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলির ব্যবহার অনেক অর্থেই সঠিক জায়গা মতো হয় না। যে জিনিসটি বাংলা ভাষার অন্যতম বড় সম্পদ, যে প্রবাদ, প্রবচন, বাগধারা, আলংকারির শব্দগুলোই হারিয়ে যাচ্ছে কথ্য ভাষা থেকে, লিখিত ভাষাতেও যার সরাসরি প্রভাব পড়ে।
শেষ দু-দশকে কটা উপন্যাস আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হল? শেষ দশকে কটা আঞ্চলিক কবিতা শহুরে অনুষ্ঠানে পাঠ হল? বিগত এক দশকে ক্রমাগত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলা ভাষার সাহিত্যে। পুরীর জগন্নাথ দেবের খিচুড়িতে নানান উপাদান মিলে থাকে তাই তার নাম জগা খিচুড়ি, আমার-আপনার মাতৃভাষাও তাই হয়ে গিয়েছে।
বাঙালি অনুকার শব্দ বলা কমিয়ে দিয়েছে, বাঙালির বিশেষণ ব্যবহার তলানিতে ঠেকেছে! ইস্তক, নিদেন পক্ষে এই শব্দগুলো ব্যবহার করতে ভয় পায় সাধারণ বাঙালি। যদি ভুল বলে ফেলে! এই কথাগুলো যদি তাকে গ্রাম্য প্রমান করে দেয়! নীতিপুলিশির আতঙ্কে একে একে শেষ হচ্ছে ভাষায় সৌন্দর্য্য।
সাধারণ একটা উদাহরণেই দেখুন…
অভীক আর ওভীক, যে লোকটি ওভীক বলে তাকে আমরা ভুল বলে দাগিয়ে দিচ্ছি, সমাজের ভয়ে সে ভাবছে কীভাবে ডাকব? ভুল ডেকে ফেলব নাতো? এই ভাবতে ভাবতে একটা একটা করে ভাষা ব্যবহারকারী কমে যাচ্ছেন। কখনও এভাবে ভেবে দেখেছেন আপনার উচ্চারণ করা অভীকই, অপর একজনের ভাষায় ওভীক হতেই পারে।
ঠিক ভুলের সংশোধন হোক আড়ালে, যাতে ভাষা ব্যবহার করতে কেউ সংকোচ না পায়।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর প্রতিটি ছবিতে ওপারের ভাষা বলেছেন, মানুষ তাঁকে গ্রহণ করেছেন। ওপারের ভাষা ব্যবহার ভানু বাবুর শক্তি, নিজস্বতা। কিন্তু আজ আপনার সহপাঠী কেএফসি-তে খেতে গিয়ে একখান ফ্রেঞ্চ ফাই দ্যান না…বললেই আপনি রেগে যাবেন, হয়ত উঠেও যাবেন। লজ্জায় আপনার বন্ধুটি আর দ্বিতীয়বার আপনার সামনে ওই ভাষা ব্যবহার করবেন না। দ্যান না বলা একটি লোক কমে গেল। এইভাবে কমতে কমতে একদিন ওই ভাষাতে কথা বলার মতো আর কেউ অবশিষ্ট থাকবেন না।
লগে, সাথে, এগুলো সঙ্গের চেয়ে কোন অংশে খারাপ নয়, এগুলোই বাংলাকে মিষ্টি ভাষা বানিয়েছে। এই বৈচিত্র্যই বাংলা ভাষাকে এতো কাল সজীব রেখে এসেছে। এই মিষ্টত্ব যেন অক্ষত থাকে। বাংলা ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে, একবার নয় বারবার মৃত্যুঞ্জয়ীরা আত্মত্যাগ করেছেন। তারপর আমরা মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি, এ দৃষ্টান্ত আর কোন ভাষায় নেই। এ গর্ব যেন নষ্ট না হয়ে যায়। অচিরেই বাংলাকে সংস্কৃত হতে দেবেন না। প্রতিটি আঞ্চলিক রূপভেদ সমমর্যাদা পাক। গর্বের সঙ্গে বাংলা বলুন।