বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

খাদ্যরসিক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

March 12, 2024 | 4 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: রামকৃষ্ণ পরমহংস; ভক্তদের কাছে তিনি ঠাকুর, যুগাবতার এক সাধক। কিন্তু মানুষ রামকৃষ্ণদেব কেমন ছিলেন, তা কি আমরা আদৌ জানার চেষ্টা করি? দেবত্তর চাপে হারিয়ে যায় আসল মানুষটি। আদপ মানুষটি নাগাল পেতে তাকে কাছ থেকে জানতে হয়। তিনি ছিলেন আদ্যন্ত খাদ্যরসিক, এক্কেবারে শিশুর মতো। গরম সহ্য করতে না পেরে বরফ খেতেন, হুঁকোর প্রতিও ছিলেন দুর্বল।

গদাধর চট্টপাধ্যায়কে আমরা চিনব তাঁর খাদ্যপ্রীতি থেকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খাদ্যাভাস বলে দেয় কেমন মানুষ ছিলেন তিনি। ভক্তের সেবার্থে মা কালীর কাছে ডাব-চিনি যেমন চাইতেন, তেমনই ভক্তদের আপ্যায়নে নিজেও রকমারি খাবারের পদ খেতে ভালোবাসতেন। কিশোর গদাধর দক্ষিণেশ্বরের খাবার মুখে তুলতেন না, কারণ জান বাজারের রানী ছিলেন কৈবর্ত। শূদ্রানীর হাতে কি করে এক ব্রাহ্মণ খাবাবার খাবেন! তাই নিজের হাত পুড়িয়ে সেদ্ধভাত রান্না করে খেতেন। এহেন রক্ষণশীল ঠাকুর হয়ে উঠলেন প্রেমের ঠাকুর। অকাতরে বিলিয়েছেন প্রেম।

ঠাকুর ছিলেন পেট রোগা মানুষ, বরাবর হালকা রান্নাই খেয়ে এসেছেন। মন্দিরে ঘিয়ে রান্না করা গুরুপাক ভোগ ছুঁয়েও দেখতেন না। পান করতেন গঙ্গার জল, তাই পেটের অসুখ লেগেই থাকত। প্রথম দিকে হৃদয়রাম ও পরে সারদা মা রান্না করা খাবারই খেতেন। সে খাবার ছিল পথ্যের সমতুল্য। ঠাকুরের জন্য মায়ের রান্না করে দেওয়া ব্যাঞ্জনকে নরেনও রোগীর পথ্য বলেছেন। নিজের ভাগের বরাদ্দ মন্দিরের গুরুপাক খিচুড়ি ভোগ, মন্দির কর্তৃপক্ষের থেকে নিয়ে বিলিয়ে দিতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে।

ঠাকুরের প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল মিষ্টি, প্রখ্যাত ভীমনাগের সন্দেশ তাঁর অন্যতম প্রিয়। তবে অন্য দুই মিষ্টি সাদা বোঁদে ও জিলিপি ছিল ঠাকুরের সর্বাধিক প্রিয় দুটি মিষ্টি। জনশ্রুতি রয়েছে ঠাকুর কামারপুকুরের সত্যকিংকর মোদকের দোকানে সাদা বোঁদে খেতে খুব ভালবাসতেন। অনেকেই বলেই মোদকদের বাড়ির কোন ছেলে ছিলে ঠাকুরের সহপাঠি। সাদা বোঁদে হল ঠাকুরের জন্মস্থান কামারপুকুরের বিখ্যাত মিষ্টি। রমাকলাই থেকে এটি তৈরি করা হয়। কামারপুকুর ছাড়া অন্য কোথাও এ জিনিস পাওয়া যায় না।

জিলিপির পরেই যে খাবারটির কথা চলে তা হল কচুরি। লুচি, পুরি, পরোটা খেতে ঠাকুর খুবই ভালবাসতেন। মাকে ঠাকুর নরেনের জন্য মোটা মোটা পরোটা আর ডাল বানিয়ে দিতে বলতেন। এটাই প্রমান করে কতটা ভোজন রসিক ছিলেন ঠাকুর। গিরিশ ঘোষ তাকে খাবারের পাত থেকে উঠিয়ে দিচ্ছেন; ঠাকুর বলছেন অমন সুন্দর সুন্দর গরম নুচি খেতে দিলে না গিরিশ, আবার নিজে যখন অসুস্থ মুখে কিছুই তুলতে পারছেন না, সেই অবস্থাতেই গিরিশকে কচুরি খাইয়ে দিচ্ছেন। আটা-ময়দার এই ভাইয়েরা ছিল ঠাকুরের প্রিয়পাত্র। আসলে উত্তর কলকাতা হল চপ কচুরির রাজধানী। সেটাই ছিল ঠাকুরের বিচরণক্ষেত্র।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবই চেটেপুটে খেতেন ফাগু সাহুর কচুরি। কিন্তু কে এই ফাগু? পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফাগু সাহু ছিলেন বিহারের বাসিন্দা। কাজের খোঁজে বিহার ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর আর ফিরে যাননি। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে চলে আসছে তাঁর এই ব্যবসা।​ বরাহনগরের প্রাচীন এবং সুপ্রসিদ্ধ ‘মুখোরুচি’ নামের নিরামিষ তেলেভাজার দোকানের সঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের সম্পর্ক ঘিরে কতই না গল্প-ইতিহাস। রামকৃষ্ণদেব ফাগুর খুব ভক্ত ছিলেন। একদিন কলকাতা থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে ফিরছেন। সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল এবং গাড়ির কোচম্যান। রাস্তার ওপারে ফাগুর নিরামিষ তেলেভাজার দোকান। রামকৃষ্ণদেব রামলালের কাছে জানতে চাইলেন, “ট্যাকে পয়সা আছে?” রামলাল হ্যাঁ বলতেই নির্দেশ এল, “যাও কচুরি কিনে আনো।” রামলাল কচুরি আনতে গেলেন। রামকৃষ্ণদেব বসে গাড়িতেই। ফাগু খুব যত্ন করতেন রামকৃষ্ণকে। প্রথমেই তিনি জল ও দুই খিলি পান দিলেন। তারপর দিলেন কচুরি। রামলাল সেই কচুরি এনে দেখেন রামকৃষ্ণদেব গাড়িতে নেই। কোচম্যানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঠাকুর অনেক আগেই গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে গেছেন।” রামলাল তখন রামকৃষ্ণ যেদিকে গিয়েছেন সেই  দিকে ছুটলেন। কিছুদূর গিয়ে তাঁকে দেখতে পেয়ে রামলাল জানতে চাইলেন, “কোথায় যাচ্ছেন একা?” রামকৃষ্ণদেব তখন ভাবের ঘোরে বলছেন, “ফাগুর কচুরি খাব”। সেই ভাবের ঘোরেই গোঁ ধরে তিনি হন্ হন্ করে দক্ষিণেশ্বরের দিকে হাঁটতে থাকেন।বরানগর অঞ্চলের একদিকে চলে গিয়েছে গোপাললাল ঠাকুর রোড, তার অন্যপ্রান্তে কাশীপুর রোড। এমনি দুই রাস্তার সংযোগস্থলে কালী মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত নিরামিষ তেলেভাজার ‘ফাগুর দোকান’, যার নাম ‘মুখোরুচি’। ইতিহাস এই দোকানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। দোকানে ঢুকলেই ফটোফ্রেমে বাঁধানো একটি বিশেষ লেখা, “এই কালী মন্দিরের ঠিক উত্তরপার্শ্বে ফাগুর দোকান ছিল। ফাগুর দোকানের কচুরি খাইতে শ্রী শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভালবাসিতেন যেখানে সেই খোলার চালের খাবার দোকান ছিল সেখানে এখন পাকাবাড়ী উঠিয়াছে, একখানি খাবারের দোকানও সেই স্থানে চলিতেছে নাম মুখোরুচি।” লেখাটির নিচে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের ১৯৬৭ সালের সোভিনিয়রের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে দোকানের পাশে একটি কালীমন্দির আজও রয়েছে। খুব সম্ভবত, দোকানে ঝোলানো ফটোগ্রাফটিতে যে কালীমন্দিরের নামোল্লেখ করা হয়েছে এটি সেই মন্দিরই। আবার এই দোকানের সামনে দিয়ে বিস্তৃত কাশীপুর রোডের ওপর কিছু দূরেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বসতবাড়ি ‘উদ্যানবাটী’ অবস্থিত। সুতরাং কালীপ্রতিমা দর্শনের আশায় রামকৃষ্ণদেব যখন মন্দিরে যেতেন, তখনই ফাগুর দোকানের কচুরি খেতেন। লোকমুখে এমন গল্প আজও ঘোরে।

এবার আসি আসল কথায় আজকের ভেগানদের এবং অতিভয়ঙ্কর হিন্দুত্ববাদীদের কল্যাণে নিরামিষ আন্দোলন শুরু হয়েছে। ঠাকুর কিন্তু কোনদিন আমিষ বর্জন করতে বলেননি এমনকি নিজেও করেননি। ঠাকুরের প্রিয় ছিল জ্যান্ত মাছের ঝোল। আজও কোয়ালপাড়া মঠে ভক্তদের প্রসাদে মাছ দেওয়া হয়। ছোট মাছ খেতেও ভালবাসতেন ঠাকুর। গেরি গুগলীর তরকারিও ছিল প্রিয়। আর মাংস? হ্যান তাও খেতেন ঠাকুর। যখন অসুস্থ তখন তাকে তরল খাবার দেওয়া হত। মাংসের সুরমা থাকত দৈনিক। সাহিত্যিক শংকর লিখেছেন, ঠাকুর ডিমও খেতে চেয়েছিলেন। কাজেই সংসারী সাধক ঠাকুরকে হালের ওই তথাকথিত উত্তরপ্রদেশীয় গো বলয়ে বাঁধতে যাওয়ার যে চেষ্টা হচ্ছে তা অনেকেই পীড়া দেয়।

আরও পীড়া দেয় অন্য এক কথায়, যে ঠাকুর এতো ভোজন রসিক ছিলেন; সেই তিনিই অবিশ্ব ক্ষুদা নিয়ে চলে গিয়েছেন। শেষ কিছু মাস খেতেই পারতেন না, গলায় ঘায়ের কারণে নামতো না খাবার। নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসত সব। শেষের দশ মাস উদ্যানবাটিতে থাকাকালীন কোনদিন ভাত খেতে পারেননি তিনি। শেষ খাওয়া ছিল মায়ের হাতের তৈরি পায়েস জাতীয় কিছু একটা। আজ তাঁর নামে সারা বিশ্বে কোটি কোটি অভুক্তের পেট ভরে, আহারের গরম ভাতই তো পরম ব্রহ্ম। এখানেই তো দেবত্তের আবির্ভাব হয়।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#birth anniversary, #Sri Sri Thakur, #Ramkrishna paramhansa deb

আরো দেখুন