কবি জসীমউদ্দীনকে কেন ‘পল্লীকবি’ বলা হয়?
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: জসীমউদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় পল্লিসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। তবে তাঁর কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটে ছাত্রজীবনেই। তখন থেকেই তিনি তাঁর কবিতায় পল্লিপ্রকৃতি ও পল্লিজীবনের সহজ-সুন্দর রূপটি তুলে ধরেন। পল্লির মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর অস্তিত্ব যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। কলেজজীবনে ‘কবর’ কবিতা রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য।
‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোটো গাঁয়।
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়….”
এই জনপ্রিয় কবিতাটির রচয়িতা কবি জসীমউদ্দীন। তিনি জন্মেছিলেন ১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে। ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। তার পৈত্রিক ভিটা তাম্বুলখানার পাশের গ্রাম গোবিন্দপুরে। এই গোবিন্দপুরেই কবির বাল্যকাল ও কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে। কুমার নদীর তীরে এই গোবিন্দপুর গ্রাম। এই গোবিন্দপুরেই কবি জসীম উদ্দীনের তিন পুরুষের ভিটা।
‘পল্লীকবি’ উপাধিতে জসীমউদ্দীন বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় পল্লী সাহিত্যের আখ্যানপ্রবণতা প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি তার বিষয় হিসেবে পল্লী বাংলার জীবনকেই চিত্রিত করেছেন। কিন্তু সে জন্যই তাকে ‘পল্লী কবি’ বলা কি সেটা আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া কবি যে গদ্য গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন-তার মূলও অনেক। সত্যিই আমরা ভুলতে বসেছি যে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে কবির আত্মজীবনী বা স্মৃতি কথা জাতীয় গ্রন্থগুলো এবং ভ্রমণ কাহিনী আর গল্প ও উপন্যাসসমূহ যে সহজ অনুপম শিল্প আকারে লাভ করেছে তাতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়ে আছে তার অতি আধুনিক মন, মনন, চিন্তা ও সামাজিক দর্শন।
আমাদের মধ্যযুগের মূল ধারার কাব্যেও কাহিনী বা আখ্যান আছে এবং তার পটভূমি পল্লী বা নগর যাই হোক না কেন, যে হিসেবে ভাগ করে আমরা তাকে পল্লী সাহিত্য বা নাগরিক সাহিত্য বলি না। কারণ সাহিত্যের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, শিল্পের প্রকাশ শৈলীর ধরণ ও ভঙ্গি অনুযায়ী তার চরিত্র নির্ধারণ হয়। আমাদের দেশে অসংখ্য ‘পথুয়া কবি’ বা পল্লী কবি আছেন তারাও কোনো না কোনোভাবে সমকালীন ঘটনা নিয়ে কাব্য চর্চা করেছেন এবং কবিতা রচনা করে থাকেন। সেই সব কবিতা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তার পুনঃপ্রকাশ বা পুনঃপ্রচার না করে কবি অন্য কবিতা রচনায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।
এটা পল্লী কবির কবিতা রচনার একটা প্রধান ধারা। কিন্তু কবি জসীম উদ্দিনের কবিতা কি এমন সাময়িক? মোটেই তা নয়। কবির নকশি কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, এক পয়সার বাঁশি, একের পর এক সংস্করণের পর সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। অতএব, কবির কবিতা নির্মাণ কলায় এমন কিছু আছে যা বাঙ্গালি জীবনের সমকালীনতাকে ধারণ করে। সেজন্যই কবিকে পল্লী কবি না বলে বাঙ্গালির কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যথার্থ এবং সম্মানজনক হবে বলে মনে করি। পল্লী কবিরা গ্রাম বাংলার মানুষের সংবাদ পিপাসা ও রসতৃষ্ণাকে মেটাতে পারলেও তাতে তাদের চৈতন্যের স্তরের বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। হৃদয়ে খুব একটা বিকশিত হয় না। এমনি গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে তা পুনঃপ্রচারের উত্তরণ ঘটে না। এখানেই কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা পল্লী কবিতা থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে আছে।
পল্লী কবির কবিতা স্টোরিও টাইপ, পুনরাবৃত্তিময়, নিয়ম এবং ছকে বাধা। জসীম উদ্দীনের কবিতা কি তাই? আমার মতো সবাই এ প্রশ্নের উত্তরে বলবেন না। তাহলে জসীম উদ্দীনকে কোন যুক্তিতে পল্লী কবি বলবো? কোনো যুক্তি তর্কে জসীম উদ্দীনকে পল্লী কবি বলা সম্ভব নয়, অতএব বাঙ্গালি এবং বাংলা ভাষাভাষির অন্যতম জসীম উদ্দীনের কবিতা রাখালিয়া সুর ও পল্লী জীবনের ভাববস্তু আছে। আরো আছে কথকথার ধরণ ও আখ্যান প্রবণতা! কবি তার কবিতায় দেশ কাল,সমাজ, মানুষ ও জীবন চিত্র চিত্রিত করেছেন তা শুধু কেবল সুন্দরই নয় বলতে হয় কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা সংহত, পরিপাটি ও অনুপম শিল্প আকার লাভ করেছে।
কবি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর মন্তব্য করেন, জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব-ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্রকৃতি কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে লিখতে পারে না। তিনি, জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ কবিতাকে সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, আমি এটাকে আদরের চোখে দেখেছি, কেনো না এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী জীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে। আর এক ধরনের পল্লী কবিতা আছে যা ভাব গভীর ও দার্শনিকতাপূর্ণ। এতে গ্রাম বাংলার স্বকীয় চিন্তন প্রক্রিয়ার একটা ধারা পাওয়া যায়।
এই সব কবিতার ভাবুকতা যথেষ্ট উচ্চ মানের বৈকি! বাউল সম্রাট লালন ফকির, হাসন রাজা, রাধারমন, সৈয়দ শাহনূর প্রমুখ কবির রচনায় এই ধারাটি সমৃদ্ধ। জসীম উদ্দীন সাধারণ লোক কবির নিরস আঞ্চলিক কবিতা এবং ভাবুক দার্শনিক লোক কবির ভাব-সাধনাকে নিবিড়ভাবে বেছে নিয়ে নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেছেন। এই ধারা আসলে এক ধরনের পূর্ণ নির্মাণ। অপ্রধান কবিদের মধ্যে যে মাঝে মাঝে আলোর বিচ্ছুরণ থাকে শক্তিমান কবি সেই সম্ভাবনাময় অংশকে একটু ঘষে মেজে, একটু রংয়ের ছোপ দিয়ে সে অংশটুকুকে আলোচিত করে বা জীবনের প্রাণবন্ত স্পর্শ শিল্প সৃষ্টি করে গড়ে তোলেন।
কবি জসীম উদ্দীন শুধু বড় মাপের কবি নন, একজন সুখ্যাত গল্পকার হিসেবেও তিনি চির অম্লান হয়ে আছেন বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে।