বাংলার বিরুদ্ধে কৃষ্ণনগরের রাজ-পরিবারের জোড়া চক্রান্তের ইতিহাস জানেন?
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি:
ইকির মিকির চামচিকির,
চামে কাটা মজুমদার।
ছেলেবেলায় খেলা, এই খেলাখানির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস। ইকির মিকিরের অন্দরে রয়েছে কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের উৎপত্তির কথা। খেলা আর ছড়ার মোড়কে বাংলার ইতিহাসকে ছন্দে মুড়ে ফেলা হয়েছে। আকবরের শেষ জীবনে প্রতাপাদিত্য বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছিল। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠালেন। বাংলার বারো ভুঁইঞাদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করতে হবে, বাংলার দখল নিতে হবে। মানসিংহকে সাহায্য করলেন বাংলার তিনজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁদের প্রত্যেকেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’। তাঁরাই হলেন বাংলার বিখ্যাত তিন মজুমদার, ভবানন্দ মজুমদার, লক্ষীকান্ত মজুমদার এবং জয়ানন্দ মজুমদার। এঁদের মধ্যে হুগলির কানুনগো দপ্তরের মুহুরি ভবানন্দ মজুমদারকে মানসিংহের বাংলা অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। ভবানন্দ মজুমদার ছিলেন মানসিংহের খবরি। টাকার বিনিময়ে, বাংলার সব খবরাখবর মান সিংহকে পাচার করতেন ভবানন্দ মজুমদার।
মানসিংহ জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আসতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়লেন। সময়টা ছিল চৈত্র মাস। বাংলায় চৈত্র-বৈশাখের ঝড় বড় মারাত্মক, কালবৈশাখীর কবলে পড়েছিলেন মানসিংহ। ওই ঝড়ের পরে মানসিংহকে নৌকো করে নদী পার হতে সাহায্য করেন ভবানন্দ মজুদার। এককালে যশোরে থাকার সুবাদে পথঘাট তাঁর চেনা ছিল, তিনিই সৈন্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন, চূর্ণী নদী পেরিয়ে চাকদহে পৌঁছে যান মানসিংহ, তারপর বাকি ইতিহাস সকলের জানা।
নিজের বাড়িতেও মানসিংহকে নিয়ে এসেছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার বিপুল আয়োজন করেছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। মোঘল সম্রাটের সেনাপতিকে যে ভবানন্দ ‘জামাই’ আদরে রেখেছিলেন, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাবতে অবাক লাগে! বাংলার নিজের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ‘চামচিকির’ কথাটার দ্বারা বিশেষ সুবিধের নয় এমন ব্যাক্তিদেরই বোঝানো হয়েছে। ‘চামে কাটা’ মানে যার ‘চামড়া নেই’ বা নির্লজ্জ–বেহায়া গোছের লোকজন। এই ইঙ্গিতটি মানসিংহের সাহায্যকারী বিশ্বাসঘাতক মজুমদারদের প্রতিই করা হয়েছে।
প্রতাপাদিত্যকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন মানসিংহ, সে’সময় প্রতাপাদিত্যর মৃত্যু হয়। বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ সালে নদিয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ, মহৎপুর, লেপা, কাশিমপুরের মতো ১৪টি পরগণার ফরমান লাভ করেন। রামচন্দ্র সমাদ্দারের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভবানন্দই নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা৷ ফরমান লাভের পর থেকেই তাঁরা রায় উপাধি ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। প্রথমে বাগোয়ান গ্রামে রাজধানী স্থাপন করেন ভবানন্দ, সেখান থেকে রাজধানী চলে যায় মাটিয়ারীতে। পরে ভবানন্দের পৌত্র রাঘব রায় মাটিয়ারী থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন রেবতী নামক স্থানে৷ জনশ্রুতি অনুযায়ী, কৃষ্ণর অগ্রজ বলরামের স্ত্রী রেবতীর নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয়েছিল রেবতী, পরে লোকমুখে তা রেউই হয়ে যায়৷ রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র রায় ছিলেন পরম কৃষ্ণভক্ত৷ তিনি শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে রেউই গ্রামের নতুন নামকরণ করেন কৃষ্ণনগর৷ ঢাকা থেকে স্থপতি আনিয়ে তিনিই
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি তৈরি করান। রুদ্র রায়ের প্রপৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন নদীয়ার রাজবংশের সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন রাজা। কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম ১৭১০ সালে, ১৭২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজত্বকালেই ফুলে ফেঁপে ওঠে কৃষ্ণনগর। তাঁর আমলকে ‘নদীয়ার স্বর্ণযুগ’ বলা যেতেই পারে৷ ১৭৮২ পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি রাজত্ব করেন।
কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন পলাশীর চক্রান্তের অন্যতম চক্রী। সাহায্য করেছিলেন ব্রিটিশদের, জগৎ শেঠের বন্ধু হিসেবে লাভবান হয়েওছিলেন। অন্যদিকে, সিরাজের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আস্ত গিয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য। অর্থাৎ কৃষ্ণনগরের রাজ-পরিবার দু’বার বাংলার বিরুদ্ধে চক্রান্তে সামিল ছিল।
তথ্যঋণ:
চিরকালীন ছড়া – সুনীল জানা
ছন্দে মোড়া ছড়ার ইতিহাস – সৌভিক রাজ
মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিলনাথ রায়