প্রাচীন বনেদী কলকাতায় যেভাবে দোল পালিত হত
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: প্রাচীন বনেদী কলকাতায় বাবুয়ানি ছিল দেখার মতো। বনেদী অঞ্চল বলতে সেই সময় বাগবাজার, শোভাবাজার, চিৎপুর এইসব অঞ্চলকেই বোঝাত। এসব অঞ্চলের জমিদার বা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তখন যে ধরনের বাবুয়ানি দেখা যেত সেটাকেই ‘বাবু কালচার’ বলা হয়ে থাকে। বাবুয়ানিও এনারা করে নিয়েছেন সেই সময় চুটিয়ে। এঁদের সাজগোজ থেকে চালচলন, কাজকর্ম সবেতেই ছিল বাবুয়ানির ছাপ। চুনোট ধুতি পরা বাবুদের মৌতাতের রংয়ে কী আর খামতি ছিল? ঘুড়ির লড়াই, বেড়ালের বিয়ে, বুলবুলির লড়াই থেকে পায়রা ওড়ানো, বাঈ নাচ, বাগানবাড়ি, এসব ঘিরেই বাবু জীবনে অষ্টপ্রহর লেগে থাকত মৌতাতের রং।
দোলের সময়তো বাবুয়ানি ভিন্নমাত্রা পেত! আবির, গুলালের সঙ্গে চলকে উঠত সুরাপাত্র। বেলোয়ারি ঝাড়েও যেন নেশা লেগে যেত। তার উজ্জ্বল আলোয়, বাঈজির ঘুঙুরের বোলে আর ঠুমরির সুরে ভেসে যেত নাচমহল থেকে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। আবির ছড়ানো নাচমহলে বাঈজির পায়ের ছন্দে পদ্মফুলের আলপনা তৈরি হতো। সেই সব দোলবিলাস আজও ইতিহাস হয়ে আছে।
নাচে, গানে কলকাতার এই দোল সংস্কৃতি, এটা নতুন মাত্রা পেল মেটিয়াবুরুজের নবাবের হোলি উৎসবের পর থেকে। হোলি খেলতে ভালোবাসতেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তিনি প্রেমিক, তিনি কবি। লখনৌতে থাকতেই খেলতেন হোলি। সেই সঙ্গে লিখতেন হোলির গানও—‘মারা কানহা জো আয়ে পলটকে / আবকে হোলি ম্যায় খেলুঙ্গি।’
নির্বাসিত রাজা কলকাতায় চলে এলেন। এখানেও চলল তাঁর হোলি খেলা। সেই হোলি খেলাকে ঘিরে বসত গানের আসর। কলকাতার বড় বড় শিল্পীরা ছিলেন সেই আসরের নিয়মিত অতিথি। সৌরীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে যদুভট্ট, কিংবা অঘোরনাথ চক্রবর্তীর মতো বিদগ্ধরাও ছুটে যেতেন সঙ্গীত সুধার টানে। হোলির আসর সুরে সুরে জমিয়ে দিতেন সাজ্জাদ মহম্মদ। নর্তকীর ঘুঙুরের সুরে বেজে উঠত বিরহী রাধার কাতরতা। ওয়াজেদ আলি ছিল কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর। নিজেই লিখেছিলেন নাটক, ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’।
দোলকে কেন্দ্র করে বাবুদের বাড়িতে যে নাচগানের আসর বসত, তার প্রাথমিক একটা উদ্দেশ্য ছিল সাহেবদের খুশি করা। অনেকেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে চাইতেন। বাবুদের বাড়িতে থাকত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। সকালে সেই মন্দিরে পুজো হতো। আবির কুমকুম রাগে সেজে উঠতেন রাধাকৃষ্ণ। সকালে কৃষ্ণপ্রেমে রঞ্জিত হয়ে যে দোল শুরু হতো, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ফাগুয়ার রঙে লাগত নেশা। তখন কলকাতার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতেই জমিয়ে দোল উৎসব পালন করা হতো। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সাবর্ণ চৌধুরী, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দিগম্বর মিত্র, বলরাম বসু, পশুপতি বসু, পীতরাম দাস, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, রাধাকান্ত দেব, আশুতোষ দেব, নবীনচন্দ্র বসু, ভুবন নিয়োগী প্রমুখ। বহু বাড়িতে সেই আসরে গান গাইতেন গওহরজান, মালকানজান। দোলের জন্য গান লিখতেন গিরিশ ঘোষ। একদিন সেই রং খেলা হয়ে উঠল সর্বজনীন। সাধারণ মানুষের সেই রং খেলার ছবি এঁকেছেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। সেই হোলির বিবরণ দিতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন, ‘ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। …যার ইচ্ছা হয় যারে, আবির কুমকুম মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়।’
দোল উৎসবে জমিদার বাড়িতে খানাপিনার ব্যবস্থা থাকত অঢেল। বিভিন্ন রঙের বাতাসা, মঠ, মুড়কি, কদমা, ফুটকড়াই ছিল স্পেশাল। ঠাকুরকে সেসব নিবেদন করা হতো। পাশাপাশি বাড়িতে বসত ভিয়েন। খাজা, গজা, বোঁদে, ক্ষীরকদম, সীতাভোগ, লবঙ্গলতিকা সহ নানা ধরনের মিষ্টি তৈরি হতো। সেই সঙ্গে থাকত, লুচি, ছোলার ডাল, এঁচোড়ের দম, ছানার তরকারি, চাটনি, পায়েস। এককথায় ঢালাও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা।