রঙের উৎসবে ঘুরে আসতে পারেন কল্যাণী সতীমার দোলমেলায়
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: নদীয়ার দোলের আরেক অনন্য উপাখ্যান হল কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমার দোলমেলা। আনুমানিক দুশো বছর আগে, আউলিয়া সম্প্রদায়ের সতীমা অর্থাৎ সরস্বতী দেবী এই মেলার প্রবর্তন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে আউল সমাজ। এই সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন আউলচাঁদ। তাঁর মৃত্যুর পর আউল সমাজের কর্তাপদ লাভ করেন রামশরণ পাল। তাঁরই স্ত্রী ছিলেন সরস্বতী দেবী, যিনি পরবর্তীকালে সতী মা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, ১৬৯৪ সালে শান্তিপুরের কাছে উলা নামে এক গ্রামের মহাদেব নামের জনৈক এক বৈষ্ণব ব্যাক্তি পানের বরজে সুন্দর এক মানব শিশুকে কুড়িয়ে পান। সে’দিন ছিল পূর্ণিমা, তাই সেই ছোট্ট ছেলেটির নাম রাখা হল পূর্ণচন্দ্র। সেই থেকে শুরু হয় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ইতিহাস। পূর্ণচন্দ্র প্রথমে ধর্মশাস্ত্র ও পরে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন, জন্ম হয় আঁউলচাঁদের। তারপর তিনি গৃহত্যাগ করে, বাকি ইতিহাসটা প্রায় সকলেরই জানা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি চলে আসেন নদীয়ার ঘোষপাড়ায়। ডালিম তলায় বসেন। এই দিকে রামশরণ পাল নামে গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির স্ত্রী সরস্বতী দেবীর রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার মরণাপন্ন অবস্থা হয়। তাঁকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে কাছের এক পুকুরের থেকে মাটি তুলে সেই মাটি সারা গায়ে লেপে দেন আঁউলচাঁদ। কিছুক্ষনের মধ্যে সরস্বতী দেবী সুস্থ বোধ করতে শুরু করেন এবং প্রাণ ফিরে পান। এই সরস্বতী দেবীই হলেন ‘সতী মা’, যার নামে ‘সতী মায়ের মন্দির’ এবং ‘সতী মায়ের মেলা’। তাঁর ২২ জন শিষ্য নিয়ে শুরু হয় প্রথম কর্তাভজা সম্প্রদায়। পরবর্তীকালে দুই বাংলা জুড়ে ছেয়ে যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়। ঘোষপাড়াকে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র করার কাণ্ডারি ছিলেন রামশরণ পাল, তারপরে রামশরণ পালের অপূর্ন কাজ শেষ করেন সতী মা নিজে ও তাঁদের ছেলে দুলালচাঁদ। দুলালচাঁদই প্রথম এই সম্প্রদায়কে প্রথম সংগঠিত করেন।
প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার আগের দিন থেকে সারা রাত থেকে দোলের দিন পর্যন্ত এই মেলা হয় কল্যাণী ঘোষপাড়াতে। এই সময় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দেব-দেবী, একজন গুরু বানাও; যাকে ওনারা বলেন মহাজন আর তাঁকে ভক্তিভাবে পুজো করো। দুই বাংলার সব কর্তাভজারা আসেন তাদের মহাজনকে খাজনা দিতে। সবাই মিলে আসেন, ২ দিন এক একটা দলের এক সাথে খাওয়া-দাওয়া হয়। এই কারণে এই মেলার এক বিশেষ দিক আছে। এই মেলাতে থালা-বাটি, শাক-সব্জি, মুদিখানা, মাছ, জ্বালানির শুকনো কাঠ সব কিছু পাওয়া যায়। আগে যে ডালিম গাছের কথা বললাম সেই ডালিম গাছ এখনও আছে মন্দিরের ভেতরদিকে, আর যে পুকুরের কথা বললাম সেটা এখনও আছে দুধ পুকুর নামে। ভক্তরা এই দুধ পুকুরে স্নান করে দণ্ডি কেটে ডালিম গাছ পর্যন্ত গিয়ে পুজো দেন।
ভক্তরা ডালিমতলায় মানত করেন, হিমসাগরের জলে স্নান করে পুণ্যার্জন করেন, সতী মায়ের সমাধিতে সিঁদুর আর নোয়া দেন। আর মনস্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডি কেটে কিংবা ভাবের গান গেয়ে জানিয়ে যান কৃতজ্ঞতা। ডালিমতলার চারপাশে অসংখ্য ডালার দোকান। পুজোর উপকরণ বলতে মাটির সরায় খই-বাতাসা কিংবা মঠ; এই হল পুজোর ডালি। পুজো দিয়ে ভক্তেরা এই মহার্ঘ্য প্রসাদটুকু নিয়েই ঘরে ফিরে যায়। দোলের আগের দিন থেকে দোলের পরে পাঁচ দিন পর্যন্ত চলে উৎসব। তবে মেলা চলে দু’সপ্তাহ। মেলাটি মূলত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। কল্যাণীর ঘোষপাড়া স্টেশনে নেমে জনস্রোতের পিছু পিছু পৌঁছে যাওয়া যায় সতীমার মেলায়। ‘জয় সতীমা-র জয়’ ধ্বনি-মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ আবিরে রাঙা। চারদিক থেকে এলোমেলো ভাবে ওড়ানো হয় ফাগ। মেলার বিভিন্ন জায়গায় আউল, বাউল, ফকির, কিংবা সন্ন্যাসীদের আখড়া। তাঁরা ভাবের গান গান। এ মেলা যেন বৈরাগ্য আর আনন্দের এক মিলনক্ষেত্র। প্রচলিত রয়েছে একাধিক কাহিনি। একটি হল আউলেচাঁদ বা আউলচন্দ্র রামশরণ পালসহ একুশ জনকে দীক্ষা দেন।
অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, উলা বীরনগরের মহাদেব বারুইয়ের পানের বরজে একটি শিশুকে পাওয়া যায়। শিশুটির নাম হয় পূর্ণচন্দ্র। পরে সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে পূর্ণচন্দ্রের নাম হয় আউলচাঁদ। নানা স্থানে ধর্ম প্রচার ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ করে তিনি এসেছিলেন এই ঘোষপাড়ায়। বহু মানুষের বিশ্বাস আউলচাঁদই নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। ইনি কর্তাভজাদের কর্তা। সতীমার গর্ভে জন্ম নেন দুলালচাঁদ। লোকবিশ্বাসে এই দুলালচাঁদই হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের নিমাইচাঁদের অবতার। তাঁর সময়ই মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় ব্যাপক প্রসার ঘটে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রামশরণ পালের বংশধরদের জমিতে এই মেলা বসে। বর্তমানে এই মেলা পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে কল্যাণী পুরসভা। মেলায় দোকান বসে চার-পাঁচশো। সাত দিনের মেলায় দোলের আগের দিন থেকে পরের দিন এই ২৪ ঘণ্টা মেলা চলে। দোলপূর্ণিমার সকালে হয় দেব-দোল। তার পর শুরু হয়ে যায় আবির খেলা। সতী মায়ের ভিটে লাগোয়া এলাকা থেকে মেলাপ্রাঙ্গণ রঙিন হয়ে ওঠে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে। তার পর স্নান খাওয়া সেরে মেলার কেনাকাটা। ততক্ষণে আখড়ায় আখড়ায় জমে ওঠে গানের আসর। দূর-দূরান্তের যাত্রীদের আশ্রয়স্থল এই আখড়াগুলি। মেলায় জমে ওঠে বাউল, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লিগীতির সুরে। আখড়ায় আখড়ায় সারা রাত ধরে বসে গানের আসর। শ্রোতাদের অধিকাংশই গ্রাম ও মফঃস্বলের। তৈরি হয়েছে লালন মঞ্চ। গানের পাশাপাশি বিশাল উনুন জ্বালিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা হয় আখড়াগুলিতে।