সোনম ওয়াংচুক থেকে সার্বিক সিস্টেম: ২৪র ‘একক’-এ শিক্ষক রূপমের প্রথম ক্লাস
মধুরিমা রায়
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2024/04/rupam-1024x576.jpg)
নিউজ ডেস্ক,দৃষ্টিভঙ্গি: ২৪’ সালে সম্ভবত একটাই ‘একক’! সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শেষ কিছুদিন এই পোস্ট বারবার ঘুরে আসছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ রক্তে লাল রঙে নীল আবেগ মিশে গেছিল। অবশেষে সেই নির্দিষ্ট সন্ধ্যে যখন নজরুল মঞ্চে নেমে এলো, কালো পোশাকের এক নির্মেদ শিক্ষক তখন দ্যুতি ছড়ালেন মঞ্চ থেকে। অজস্র ভক্ত সেই ক্লাসে স্বেচ্ছায় উপস্থিত থাকলেন, যাঁদের কারও বয়স আট পেরিয়েছে, কারও আবার আশি ছুঁই ছুঁই।
![](https://drishtibhongi.in/wp-content/uploads/2024/04/sonam-wangchuk-2-1024x459.jpg)
বাংলা ও বাঙালির এক প্রচ্ছন্ন অহং কাজ করে তাঁর সাহিত্যে পারদর্শিতা নিয়ে। একদম প্রথমেই বোধহয় তাই শিক্ষক সেই জায়গাটা একবার বাজিয়ে দেখে নিলেন। ‘একক ‘ শব্দটা কেন? অনেকে একত্রিত হলে তার ইংরিজি আর বাংলা কী হয় থেকে ‘ একক ‘ পর্যন্ত আসতে গিয়ে শিল্পী নিজেই সম্ভবত একটু স্তম্ভিত হলেন। তিনজন একসঙ্গে হলে কী বলা হয় তাকে? বাংলায়? ‘ ত্রয়ী ‘ শব্দটা ভর্তি অডিটরিয়াম থেকে ঠিক তিনজন বললেন। সেই তিনজনের মধ্যে এক অধম আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত পরিচিতা। বাকিদের বাংলাটা তাহলে ঠিক আসল না!
রূপম ইসলাম পেশাগতভাবে শিক্ষকতা করতেন একসময়, বর্তমানে বহু মানুষের দৈনন্দিন শিক্ষক তিনি। তাঁর জীবন দর্শনে, গানের শব্দ চয়নে বহু মানুষের নিশুতি রাত এবং খাঁ খাঁ দুপুরের সঙ্গী তিনিই। প্রতিটি ‘একক ‘ অনুষ্ঠানেই তিনি সামাজিক অন্যায়, ভন্ডামির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। মার্চের শেষ দিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাহাড় বাঁচানোর সোনম ওয়াংচুক বা মহিলা নির্যাতন, ভোটের রঙ বদল বা পোশাকের সীমাবদ্ধতায় কোনও মানুষকে মাপা – টুকরো টুকরো ছবি তাঁর গান এবং কথায় বারবার উঠে আসল এ বছরের প্রথম এককে। অনুষ্ঠান জুড়ে তাঁর গানের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ জুড়ে ছবির মেলা, প্রজেকশনের নৈপুণ্য আপনাকে ভাবাবেই।
তিনি শুরু থেকেই নির্ভীক, অদম্য। যে সময়ে রক গান নিয়ে মানুষ তাচ্ছিল্য করতেন সে সময়ের ধারাপাতেই তো আজও তিনি বহমান। তাই রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা অনেকদিন আমরা গিলে ফেলার পর যেমন দুম করে ফেটে যাই গালাগাল দিয়ে, রক্ত মাংসের রূপম ইসলামও সেটুকুই করেন। তাঁর গানে গালাগাল থাকে, যে বাঙালি ত্রয়ী বলতে হিমসিম খান, সে বাঙালিই গানের ওই নির্দিষ্ট শব্দের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। কারণ ওটাই এখন সামাজিক প্রেক্ষাপট। মানুষ বীতশ্রদ্ধ ‘সিস্টেম ‘ নামক প্রহসনের কাছে। রূপমকে কাঁটা ছেঁড়া করতে যাঁরাই আসেন, কিছু সময় পরে অস্তমিত হয়ে যান সম্ভবত যুক্তি খুঁজে না পেয়ে। বহু নিন্দুক রূপম ইসলামের এই গানে অমুকের অনুপ্রেরণা তমুকের উল্লেখ নেই বলে খাপ পঞ্চায়েত বসান। তাঁদের জন্যও ভোকাল টনিকের অভাব ছিল না খাতায় কলমের ইয়ার এন্ডিংয়ের শেষ বেলায়। ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া ‘ গানটির জন্মবৃত্তান্ত আমরা তো অনেকেই জানি না। সেই উৎসও কাল অনেকেই পেয়েছি ‘একক ‘ সন্ধ্যায়। কাজেই কাউকে ক্রুশবিদ্ধ করতে গেলে আগে অন্তত বাকি প্রেক্ষাপট যে জেনে নিতে হবে, এ শিক্ষা বর্তমান প্রজন্মকে কান ধরে কার্যত মনে করালেন রূপম ইসলাম।
বিপ্লব আর প্রেম যে সমান্তরাল সে কথা তো রাজনীতিতে কৌতূহলী বাংলা জানে না এমন না, তবু আজকাল সবই যেন ম্রিয়মাণ। সেই কৌটবন্দি আবেগ প্রতিবার ‘একক ‘ এলেই নাড়াচাড়া পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যে বা যাঁরা প্রেমের মানুষ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের অনুষ্ঠানের শেষ গানে অনেককেই জায়ান্ট স্ক্রিন জুড়ে আহ্লাদিত হতে দেখা গেল, আর যাঁরা ‘একক ‘ একাই উপভোগ করেন তাঁরা প্রতিটা গানের শব্দে সম্ভবত সেই কাছের মানুষটাকে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহেও ছিটকে আসা মুহূর্তে অনুভব করছিলেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।
গল্প যখন ‘মিলনান্ত’ হয় না, তখন তো মানুষ মুহূর্ত জুড়েই বেঁচে থাকে। এই মিলনান্ত শব্দটিও যে অনেক বঙ্গসন্তান জানেন না, অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে শিক্ষক রূপম ইসলাম মনে করিয়ে দিলেন, শুধরে দিলেন। আমরা জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝে বহু চরিত্র পাই যাঁরা শুধুই আপনাকে আমাকে নিয়ে নিন্দে মন্দ করবেন, নয়তো গদগদ আবেগে ভালোবাসে বোঝাবে, কিন্তু শুধরে দেবে খুব কম মানুষ। রূপম ইসলাম সেই মানুষটাই। তাই এই শিক্ষকের পরবর্তী ক্লাসরুমে আবারও কালো পোশাকে বুকের বাঁ দিকে অনেকটা আলো নিয়ে বহু ভক্ত ভিড় করার অপেক্ষায় থাকবেন।