বাংলার শিব, বাঙালির শিব
সৌভিক রাজ
বসন্ত হল বাঙালির শৈব আরাধনার সময়। ফাল্গুন থেকে চৈত্র, শিবরাত্রি থেকে নীলপুজো, গাজন, চড়ক থেকে শিবের বিয়ে, বহুরূপী আবার শিব-গৌরির নাচ; নানাবিধভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে মিশেছেন শিব। কিন্তু সে শিবের পেশীর বাহুল্যতা নেই। গাত্রবর্ণ নীল নয়। সুঠাম দেহ নয়, তিনি মোটাসোটা। তিনি গোঁফ রাখেন, কলকে টানেন আবার পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রাঁধতে বলেন। আসলে বঙ্গের লোকায়েত দর্শনে শিব মিশেছেন, কোথাও তিনি ক্ষেত্রপাল আবার কোথাও তিনি পঞ্চানন ঠাকুর। বাংলার ঘরের শিবের উপস্থাপনা শুরু হয় মধ্যযুগে, মঙ্গলকাব্য ও লোকসংস্কৃতির দৌলতে পাঁচু ঠাকুর, চাঁদ রায়, ধর্ম ঠাকুর, ক্ষেত্রপাল প্রমুখের মাধ্যমেই শিব হয়ে উঠেছেন সকলের। জেলেদের মাকাল ঠাকুরও তিনি। লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পরবর্তী আমলে ‘চাষা শিব’-এর জন্ম। তিনি মাটি কর্ষণ করেন, ত্রিশূল বন্ধক রেখে লাঙ্গল কেনেন, ফসলও ফলান। একেবারে ঘরোয়া সংসারী মানুষ হয়ে উঠছেন শিব।
কালীঘাটের পটচিত্রই হোক, বা যামিনী রায়ের আঁকা— সর্বত্রই শিব অনন্য, তিনি বঙ্গের শিব। নন্দলাল বসুর ছবিতেও বিষপাত্র হাতে শিবের ছবি ফুটে উঠেছে। শিব এখানে নিতান্ত সাধারণ মানুষ সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সবতেই বিদ্যমান। তিনি স্ত্রীকে ভয় পান। নির্ভেজাল মানুষ, যাকে নিয়ে মজাও করা যায়। আবার নিজেও মজা করেন। ঠিক যেন বাড়ির ছেলের মতোই তিনি। নানা আবদারে, আদরে আপ্যায়নে রাখা হয় তাঁকে। বাংলার মঙ্গলকাব্য শিবকে আদুরে জামাই বানিয়েছেন।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে দেখা যায়– শিবের খিদে পেয়েছে। অন্নদা রাঁধতে বসেছেন। সেই পদের বিবরণ দিয়েছেন ভারতচন্দ্র-
‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমসা।।
অন্ন মাংস সীকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিয়া।।’
অর্থাৎ শিব ঝাল, ঝোল, রসা, কালিয়া, দোলমাসহ নানা পদের সমাহারে তিনি ভোজন করবেন। ঘরের লোক হলেও, জামাই মানুষ তাঁকে ভালমন্দ তো দিতেই হয়। বিজয় গুপ্তর মনসামঙ্গলে রয়েছে শিব ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাবেন বলে বায়না ধরেছেন। আবার গাঁজা খেয়ে, নেশা করে চোখ লাল করে পড়ে থাকেন শিব। অন্নদামঙ্গলেই রয়েছে শিবের কাজকর্ম নিয়ে আর পাঁচ জন সাধারণ স্ত্রীয়ের মতোই পার্বতী অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন-
‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপূণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিলা এমন বরে।।’
এই অন্নদামঙ্গলেই শিব হাজির হয়েছেন বুড়া শিব হিসেবে। রায়গুণাকর বলছেন–
“কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া কাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল।।
কেহ বলে ভাল করি শিঙ্গাটি বাজাও।
কেহ বলে ডমরু বাজায়ে গীত গাও।।
কেহ বলে নাচ দেখি গাল বাজাইয়া।
ছাই মাটি কেহ গায় দেয় ফেলাই।।
কেহ আনি দেয় ধুতুরার ফুল ফল।
কেহ দেয় ভাঙ্গ পোস্ত আফিঙ্গ গরল।।
আর আর দিন তাহে হাসেন গোসাঁই।
ও দিন ওদন বিনা ভাল লাগে নাই।।”
বুড়ো শিবকে তাঁর সাপটিকে খেলানোর জন্য বলা হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, বুড়া শিব জটা থেকে জল বার করো। যা জীবনের সঙ্গে মেলানো, নিপাট ঘরোয়া ছবি। বাইরে থেকে কেউ এলে আমরা যেমন বলি এটা দেখাও, ওটা দেখাও; ঠিক তেমনটাই যেন উঠে এসেছে এখানে। শিবের কাছে আবদার করা যায়, বায়না করা যায়। শিব এখানে ঈশ্বর নন, বরং তাঁকে অন্যরূপে চিনেছে বাংলা। বাংলা তাঁকে আপন করে নিয়েছে। তাই বাংলায় শিব ঘরের লোক, সাধারণের একজন।
রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহ করা ছড়ায় শিব আদ্যন্ত বাঙালি জীবনের প্রতীক।
-বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যা দান।
এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,
এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।
আবার আরেক ছড়ায়-
এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর,
তারি মধ্যে বসে আছেন শিব সওদাগর।
শিব গেলেন শ্বশুরবাড়ি বসতে দিল পিড়ে,
জলপান করতে দিল শালিধানের চিঁড়ে।