বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

কীভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের জননী? মা সারদার তিরোধান দিবসে জেনে নিন কিছু কথা

July 20, 2024 | 3 min read

নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: আজ ২০ জুলাই। ১৯২০ সালে আজকের দিনেই ইহজগত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মা সারদা। কেমন ছিলেন মা? কীভাবে তিনি সকলের মা হয়ে উঠেছিলেন? তা জানতে পড়তে হয় মায়ের জীবনী।

আমেরিকার সেন্ট লুই শহরের বেদান্ত সোসাইটির স্বামী চেতনানন্দ শ্রীশ্রীমা সারদার একটি জীবনী উপহার দিয়েছেন সমাজকে। লেখক এক অসাধারণ দম্পতির আধ্যাত্মিক জীবনের কথা ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তুলেছেন। এমনিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার দাম্পত্যজীবনের কথা সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিতে হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন। চেতনানন্দ চেষ্টা করেছেন এক জটিল সম্পর্ককে যথাসাধ্য সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করতে।

তিন বছরের বালিকা সারদার সঙ্গে এক গানের আসরে প্রথম দেখা রামকৃষ্ণের। নবীন গায়ক দলের দিকে সারদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও’। বালিকা তার ছোট্ট তর্জনী অন্য দিকে রামকৃষ্ণের দিকে নির্দেশ করে বলল— একে। এরপর পাঁচ বছরের বালিকা সারদার বিবাহ হল চব্বিশ বছরের যুবক রামকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীর মন্দিরের পূজারি।

চেতনানন্দ বুঝিয়ে বলছেন, এ ধরনের বাল্যবিবাহ সেকালে প্রচলিত ছিল। তবে, একে বলা উচিত বাগ্‌দান। কারণ, কন্যা দেহে-মনে সাবালিকা হওয়ার পরই তাকে শ্বশুরগৃহে পাঠানো হত। কিন্তু ঠাকুর ও শ্রীমায়ের বিবাহ এক আধ্যাত্মিক বন্ধন। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর থেকে কামারপুকুরে যখন আসেন, মা-কে তাঁর পিতৃগৃহ জয়রামবাটী থেকে আনানো হয়। ঠাকুর তাঁকে নিজের হাতে একটু একটু করে তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্গিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি জানেন, রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্ব একদিন নিতে হবে সারদাকে। ঠাকুর নিজেকেও পরীক্ষা করেন। সারদা অন্তরে অতি পবিত্র। সারদার সঙ্গ কখনও তাঁর মনে সাধারণ মানুষের কাম-ভাব জাগ্রত করে না।

রামকৃষ্ণ ঈশ্বরকে সাধনা করেছেন শক্তিরূপিণী মাতৃমূর্তিতে। সারদা তাঁর কাছে জীবন্ত ভগবতী। সাত বছর বয়সে, নয় বছর বয়সে, চোদ্দো বছর বয়সে সারদা বার বার রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসেছেন। রামকৃষ্ণের হাতে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলেছে অনুক্ষণ।

সারদার বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি পদব্রজে জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে পৌঁছলেন। পথকষ্টে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। অসুস্থ অবস্থায় এসে পৌঁছলেন। রামকৃষ্ণ প্রাণ দিয়ে স্ত্রীর শুশ্রূষা করলেন, পথ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভাল করে তুললেন। সেই সময় ঘটল তাঁদের যুগ্ম আধ্যাত্মিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে পূজা করলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। চেতনানন্দ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। 

সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করেছেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি সারদাতে আরোপিত করলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিলেন। ফলহারিণী কালীপূজার পুণ্যদিনে ঠাকুর এই ষোড়শী পূজা করেছিলেন। সারদা তখন ষোড়শী নন, অষ্টাদশী।

শক্তিরূপিণী মায়ের এক নাম ষোড়শী। ষোড়শী অবশ্য রাজরাজেশ্বরী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামেও পরিচিত। ঠাকুরের এই ষোড়শী পূজা, নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চেতনানন্দ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন— রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন— বুদ্ধ, চৈতন্য। রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন না, তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা।

বিবেকানন্দের মতো ঠাকুর-অন্ত প্রাণ ভক্ত বার বার বলেছেন, মায়ের স্থান ঠাকুরেরও উপরে। হঠাৎ একটু খটকা লাগতে পারে। রামকৃষ্ণের আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচার করার ভার যে বিবেকানন্দের উপর ঠাকুর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর মুখে এ কী কথা? কিন্তু বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছেন, মায়ের মাধ্যমে ঠাকুর স্বয়ং নির্দেশ দিচ্ছেন। বিবেকানন্দ তাই গুরুভাইদের ডেকে ডেকে বলছেন, ওরে, তোরা এখনও মাকে চিনলি না।

বিবেকানন্দ বিশ্বজয় করে ফিরে এলেন দেশে। পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নে তাঁর বক্তৃতা সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলল। ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে তাঁর একটি সুন্দর সাক্ষাৎকারের বিবরণ আছে। স্বামীজি সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন মায়ের পায়ে। কত দিন পরে তাঁকে দেখে মায়ের চোখে পুত্রস্নেহ। উপস্থিত সকলে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ উপলব্ধি করলেন।

পাশ্চাত্যের রমণীদের সঙ্গে মায়ের সখ্যের উপর আছে কৌতূহলজনক আলোচনা। গ্রামের মেয়ে সারদা, এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। কিন্তু চমৎকার আলাপচারিতা চালিয়ে যান সারা বুল, মিস ম্যাকলয়েড বা সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু আহার করেন এঁদের সকলের সঙ্গে। 

সিস্টার নিবেদিতা বলেন, মা, তুমি আমাদের কালী। মা বলেন, না না, তবে তো আমাকে জিভ বার করে রাখতে হবে। নিবেদিতা বলেন, তার কোনও দরকার নেই। তবু তুমি আমাদের কালী, আর ঠাকুর হলেন স্বয়ং শিব। মা মেনে নেন। নিজ হাতে রঙিন উলের ঝালর দেওয়া হাতপাখা বানিয়ে দেন নিবেদিতাকে। নিবেদিতার সে কী আনন্দ এমন উপহার পেয়ে, সকলের মাথায় হাতপাখা ছোঁয়াতে থাকেন। মা বলেন, মেয়েটা বড় সরল। আর বিবেকানন্দের প্রতি আনুগত্য দেখবার মতো। নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে গুরুর দেশের কাজে লাগবে বলে। নিবেদিতার ভারতপ্রেম অতুলনীয়।

ছোট একটি ঘটনার বর্ণনায় ঠাকুরের মানবিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন চেতনানন্দ। মা চন্দ্রমণির মৃত্যুসংবাদে ঠাকুর হাউহাউ করে কাঁদছেন, ভাগ্নে হৃদয় বলল শ্লেষের স্বরে— আপনি না সন্ন্যাসী, এত বিচলিত হওয়া আপনাকে সাজে! রেগে উঠে ঠাকুর বললেন, হৃদে, তুই চুপ কর। সন্ন্যাসী হয়েছি বলে তো আর হৃদয়হীন পশু হয়ে যাইনি।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Sarada Maa

আরো দেখুন