খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধি বড় মাথাব্যথা সরকারের, বোঝালো বাজেট, বিরোধীরা বলছে ‘কুর্সি বাঁচানোর বাজেট’
নিউজ ডেস্ক, দৃষ্টিভঙ্গি: তৃতীয় মোদী সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট (২০২৪-২৫) মঙ্গলবার পেশ করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। লোকসভায় তিনি এদিন বলেন, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার নীচের দিকেই রয়েছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হবে এই বাজেটে। বেসরকারি ক্ষেত্রকেও কৃষি উৎপাদনের গবেষণায় উৎসাহিত করা হবে। সরকার চার বিভিন্ন জাতির উন্নয়নে নজর দেবে। আগামি পাঁচ বছরের জন্য যুব সম্প্রদায়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪.১ কোটি তরুণকে নিয়ে আসা হবে। এর জন্য সরকার পাঁচটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।
নির্মলা সীতারামন আরও বলেন, সরকারের লক্ষ্য থাকবে গরিব, মহিলা, যুব এবং অন্নদাতাদের প্রতি। তিনি বাজেট ভাষণের শুরুর দিকেই বলেন, এই প্রস্তাবে সরকার ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। সেগুলি হল, কৃষি উৎপাদন ও কৃষিতে স্থিতিস্থাপকতা, কর্মসংস্থান ও দক্ষতার উন্নয়ন বৃদ্ধি, মানবসম্পদ বৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচার, কলকারখানা ও পরিষেবা বৃদ্ধি, চাকরির সুযোগ তৈরি, নগরোন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো, গবেষণা ও আগামী প্রজন্মের জন্য সংস্কার।
ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রের ভোট বৈতরণী পেরতে কৃষক, আর মধ্যবিত্ত-চাকরিজীবীদের এই বাজেটে তুষ্ট করতে চাইবে তা জানাই ছিল। হলও তাই। সম্প্রতি পেরিয়ে আসা লোকসভা নির্বাচন বিস্তর শিক্ষা দিয়েছে বিজেপিকে। বছরের পর বছর ভোট দিয়েও যদি প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য থাকে, তাহলে মধ্যবিত্ত মুখ ফেরাবেই। সেটাই হয়েছে। তার উপর মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বের জ্বালা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সমীক্ষক সংস্থাগুলির রিপোর্টেই স্পষ্ট, মানুষের হাতে নগদ টাকার জোগান বাড়াতে হবে। সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাজেটের প্রাক্কালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসও বলেছেন, ‘ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়া গভীর উদ্বেগের।’
চড়া মূল্যবৃদ্ধির হার সামলানোর লক্ষ্য এদিন বাজেটে জানাতে বাধ্য হলেন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে ক্রেতা মূল্য সূচক ৪ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য জানিয়েছেন তিনি। তবে খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্য আলাদা করে বলা না থাকায় বাস্তবে এই লক্ষ্য জনতার আশু সমস্যা কতটা মোকাবিলা করবে তা নিয়ে সংশয় যথেষ্ট।
মূল্যবৃদ্ধির হার, আমজনতার বাজারের নিরিখে তৈরি ক্রেতা মূল্য সূচক বিচার করেই, অত্যন্ত চড়া। বাজেটের আগের দিন অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তা স্বীকার করতে হয়েছে অর্থ মন্ত্রককে। তবে মূল্যবৃদ্ধির দায় অনেকাংশেই চাপানো হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাড়ে।
সরকারি সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে খাদ্যে মূল্যবৃদ্ধির হার ২০২২ অর্থবর্ষে ৩.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ অর্থবর্ষে হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। এই চড়া হার সে দেশে বিশ্বের ক্ষুধার মানচিত্রে যে ভারত রয়েছে তলানিতে। ক্ষুধা সূচকে বিশ্বের ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারত ১১১ নম্বরে।
এবারের বাজেটে স্বাভাবিক কারণেই নজরে থেকেছে কৃষি। গত অর্থবর্ষ ২০২৩-২৪ পর্বে কৃষির বরাদ্দও সবটা খরচ করেনি কেন্দ্র। বস্তুত বাজেটে বরাদ্দ দেখিয়ে পরে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থের জোগান। মঙ্গলবার সীতারামন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারবে এমন শস্য ফলানোর গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। গুরুত্ব পাবে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর গবেষণা।
আবার বলা হয়েছে ১ কোটি কৃষককে বেছে নিয়ে ২ বছর পর্যন্ত জৈব চাষে উৎসাহ দেওয়ার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
নয়টি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা করেছে বাজেট। কৃষি, কর্মসংস্থান, সর্বাঙ্গীন বৃদ্ধি, কারখানা উৎপাদন এবং পরিষেবা, বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো, গবেষণা এবং উদ্ভাবন। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে পরের প্রজন্মের সংস্কার গুরুত্ব পাবে।
চলতি অর্থবর্ষেই ভোট থাকায় ফেব্রুয়ারিতে ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করেছে কেন্দ্র। নতুন লোকসভা গঠনের পর বাদল অধিবেশনে পেশ হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ভোটের মুখে ভোট অন অ্যাকাউন্টে কেন্দ্রকে ঘোষণা করতে হয়েছিল যে প্রধান মন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার মেয়াদ আর পাঁচ বছর থাকবে। সীতারামন বলেছেন, এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন দেশে ৮০ কোটি মানুষ।
করোনা মহামারি এবং লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে চালু হয়েছিল এই প্রকল্প। বিরোধীরা এই ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও বলেছেন বৃদ্ধির সুবিধা থেকে যে বিপুল অংশ বঞ্চিত তারও প্রমাণ এই ঘোষণা।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেটের সিংহভাগ প্রকল্প ও আর্থিক বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে বিহারের জন্য। বিহারের তরফে বারবার দাবি করা হয়েছিল বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিক কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমানে এনডিএ সরকারের শরিক নীতীশ কুমারও সেই দাবিতেই অনড় ছিলেন। যদিও বাজেটে বিহারকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তার বদলে বিহারের জন্য কল্পতরু হয়েছেন মোদি। বিমানবন্দর, আর্থিক সাহায্য, বিদ্যুৎ, জল, বন্যা প্রতিরোধ, সড়ক উন্নয়ন থেকে শুরু করে বাজেটে একাধিক বড় ঘোষণা করা হয়েছে শুধুমাত্র বিহারের জন্য। অন্ধ্রপ্রদেশের জন্যও কিছু আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তবে সেটা কখনই বিহারকে ছাপিয়ে যায়নি।
বিরোধীরা বারবার কটাক্ষ করে এসেছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার চলছে দু’জনের কাঁধে ভর করে। একজন হলেন জেডিইউ প্রধান তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ও অপরজন হলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা টিডিপি প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু। প্রত্যাশা ছিল এবারের বাজেটে এই দুই রাজ্যকেই ঢালাও উপহার দেবেন মোদি। অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষেত্রে সামান্য হলেও বিহারকে উজার করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। আজ, মঙ্গলবারে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেট পড়তে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেন, সড়ক-পরিবহণের গতি আরও বাড়াতে পাটনা-পূর্ণিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, বক্সার-ভাগলপুর এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হবে। বুদ্ধগয়া-রাজগীর-বৈশালী-দ্বারভাঙাতেও হবে নতুন রাস্তা। বক্সারে গঙ্গার উপরে হবে দু’লেনের সেতু। এছাড়াও বিহারের রাস্তা ও বিদ্যুতের জন্য ৪৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কাশীর ধাঁচে গয়া, বুদ্ধগয়ায় করিডর হবে। রাজগীর-নালন্দাতেও উন্নয়নের জন্য কাজ করা হবে। নতুন মেডিক্যাল কলেজ ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে বিশেষ পরিকাঠামোগত সুবিধাও দেওয়া হবে বিহারকে। প্রত্যেক বছরেই বন্যার জেরে ব্যাপক ক্ষতি হয় বিহারে। সেই কারণেও আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বন্যা প্রতিরোধে বিহারের জন্য ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। যদিও বিহারকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা না দেওয়ায় সংসদের বাইরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইন্ডিয়া জোটের সাংসদরা। বিহারের সমতুল্য না হলেও আরও এক শরিক চন্দ্রবাবুকে খুশি করতে অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের। অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী অমরাবতীর পরিকাঠামো উন্নয়নে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। এছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশের উন্নয়নে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এরই সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের দুটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডরের জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্যও করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্মলা সীতারামন। বাজেটে অন্ধ্র ও বিহারের বিষয়ে জোর দেওয়ায় কটাক্ষ করতে ছাড়েনি তৃণমূল। এই বিষয়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এই বাজেট হল কুর্সি বাঁচাও বাজেট।’ অপরদিকে ওড়িশার পর্যটনে জোর দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির জন্য নতুন পূর্বোদয়া প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন তিনি।